দেবী সারদামণি – সকলের মা, ধর্মপ্রাণা এবং সরল প্রকৃতির মানবী

দেবী সারদামণি

তিনি ছিলেন জয়রামবাটীর এক অখ্যাত পল্লী বালিকা। পরবর্তীকালে আবির্ভূত হয়েছিলেন মহাসাধক শ্রীরামকৃষ্ণের অনন্যা শক্তি হিসাবে। ব্রহ্মবিদ স্বামীর তপস্যার আলােকে উদ্ভাসিতা হয়ে ওঠেন। তিনি হলেন মা সারদা। শ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের পর তিনি সংঘমাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। নবতর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তখন তাঁকে আমরা রামকৃষ্ণ সংঘের জননী এবং পালয়িত্রী হিসাবে দেখেছি।

রামকৃষ্ণের জন্মভূমি কামারপুকুর থেকে তিন মাইল পশ্চিমে জয়রামবাটী। এই গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দামােদর নদ। এখানে আছে সিংহবাহিনীর দেউল। সেই মন্দিরের পূজারি ছিলেন মুখােপাধ্যায় বংশের ব্রাহ্মণেরা। এই বংশেই সারদামণির জন্ম হয়। তাঁর পিতা রামচন্দ্র মুখােপাধ্যায় ছিলেন শ্রী রামচন্দ্রের উপাসক ও সদাচারী ব্যক্তি। জননী শ্যামাসুন্দরী ছিলেন ধর্মপ্রাণা এবং সরল প্রকৃতির মানবী। 1

১৮৫৩ সালে ভূমিষ্ঠ হন মহাসাধিকা সারদামণি। তিনি ছিলেন মা-বাবার প্রথম সন্তান। সারদামণির জন্ম প্রসঙ্গে একটি গল্প প্রচলিত আছে। মা গেছেন শিবগ্রামে ঠাকুর দেখতে। মন্দিরের কাছে এক গাছতলায় বসেছেন। হঠাৎ দমকা বাতাস প্রবেশ করল তাঁর উদরে। গাছ থেকে নেমে এল পাঁচ বছরের এক সুন্দরী মেয়ে। সে বলল—“আমি তােমার ঘরে এলাম।”

সারদামণির জন্ম হল। পাঁচ বছর বয়সে এল বিয়ের প্রস্তাব। পাত্র কামারপুকুর গাঁয়ের ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র গদাধর। কাজকর্ম করেন দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণির কালীবাড়িতে। সদাচারী এবং সাধননিষ্ঠ এই পাত্রকে পেয়ে রামচন্দ্র খুবই খুশি হয়েছিলেন।

বিয়ের কাজ শেষ হল। সারদা এলেন শ্বশুরগৃহে। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে বাস্ত থাকতে লাগলাে। কিন্তু এবার দক্ষিণেশ্বরে যেতে হবে গদাধরকে। আর বালিকা সারদা এলেন জয়রামবাটীতে তাঁর পিতৃগৃহে।

সেই বয়স থেকেই তিনি সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে করতে পারতেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করতেন। কিন্তু কখনও ক্লান্ত হতেন না। শরৎকালে সিংহবাহিনীর পুজোতে অংশ নিতেন। শিবরাত্রিতে মন্দিরে গিয়ে শিবপুজো করে আসতেন। কীর্তন আখরাই-এর আসরে বসে ধর্মজীবনের রস-আহরণ করতেন। লেখা পড়ার সুযােগ খুব একটা ছিল না। কিন্তু পড়াশােনায় আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তাই নানা শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করলেন সেই বয়সেই।

কিশােরী সারদা নানা ধরনের অলৌকিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। যখন স্নানে যেতেন তখন কয়েকজন মেয়ে তাঁকে অনুসরণ করতেন। সারদা এই সঙ্গিনীদের দেখতে পেতেন না, কিন্তু বুঝতে পারতেন কোনাে এক মহাশক্তি তাঁকে এইভাবে পাহারা দিয়ে চলেছে। তখন থেকেই সারদা ভবিষ্যৎ আধ্যাত্মজীবনের জন্য নিজেকে তৈরি করতে থাকেন।

এই সময় রামকৃষ্ণ কিছুদিন কামারপুকুরে অবস্থান করেন। তখনই সারদাকে তিনি অধ্যাত্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। রামকৃষ্ণ চলে গেলেন দক্ষিণেশ্বরে। আর সারদামণি আবার চলে গেলেন তাঁর পিতৃগৃহে। খবর এল, রামকৃষ্ণ নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এবার যাত্রা করতে হবে দক্ষিণেশ্বরে। দুদিন পথ চলার পর সারদা অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হঠাৎ এক অলৌকিক দৃশ্যের অবতারণা হল। মমতাময়ী এক রমণী তাঁর পাশে এসে বসলেন। তিনি নিজেকে পরিচয় দিলেন দক্ষিণেশ্বর থেকে আগত এক নারী হিসাবে। তিনি চলে যাবার পর সারদার সারা শরীরের গ্লানি কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি।

দক্ষিণেশ্বরে মা সারদাকে নতুন বাতাবরণের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর স্বামী অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন। সাধারণ মানুষ তাঁর মহিমা উপলব্ধি করতে পারবে না।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তখন থেকেই সারদামণিকে শক্তির আধার হিসাবে পূজো করতেন। এমনকি ষােড়শী পুজোর সময় সারদামা প্রায়ই আবিষ্ট হয়ে যেতেন। তখন তাঁর কোনাে দিকে কোনাে জ্ঞান থাকতাে না।

আর একবার পদব্রজে চলেছেন দক্ষিণেশ্বরের দিকে। সামনে কুখ্যাত তেলােকেলের প্রান্তর। সেখানে এক ভয়ঙ্কর ডাকাত সারদামাকে আক্রমণ করল। লােকটি জাতিতে বাগদি। পাইকের কাজ করে। সারদা তাকে শান্ত করলেন। সারদার সান্নিধ্যে এসে লােকটির হৃদয়ে পরিবর্তন ঘটে গেল। এমনকি সারদাকে সে মাতৃজ্ঞানে পুজো করতে শুরু করল।

নিরক্ষরা গ্রাম্য মেয়ে স্বামীর সান্নিধ্যে এসে উচ্চতর সাধনা রপ্ত করলেন। সাধনজাত দিব্য অনুভূতি হতে থাকল তাঁর। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এবার তাঁকে বৃহত্তর অঙ্গনে প্রবেশ করতে হবে। হয়তাে ভবিষ্যতে তাঁর ওপর আরও বেশি দায়িত্বভার অর্পিত হবে।

গৃহী সন্ন্যাসী রামকৃষ্ণ স্ত্রীকে যথেষ্ট যত্ন প্রদর্শন করে গেছেন। তিনি সারদামণির আর্থিক নিরাপত্তার বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করেছেন। এতেই প্রমাণিত হয় সারদাকে তিনি কতখানি ভালবাসতেন।

এবার রামকৃষ্ণদেবের চলে যাবার সময় হয়েছে। সজল চোখে সারদামণি রামকৃষ্ণের শয্যাপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন। সারদাকে দেখে ঠাকুর বললেন— “আমার মনে ব্রহ্মভাবের উদ্দীপনা হচ্ছে।”

সারদা বুঝতে পারলেন, এ হল চিরসমাধির ইঙ্গিত। তাঁর দু’চোখ জলে ভরে গেল।

১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটি সমাগত হয়েছে। দীপ নির্বাপিত হতে চলেছে। সারদামণি কাছে এলেন, ঠাকুর বললেন“এসেছ? দেখ, আমি যেন কোথায় চলে যাচ্ছি জলের ভেতর দিয়ে অনেক দূরে…’ –

সারদামণির দিকে তাকিয়ে ঠাকুর বললেন- “তােমার ভাবনা কী? যেমন ছিলে, তেমন থাকবে আর এরা, নরেন, রাখাল, আমার যেমন করেছে তােমায় তেমনই করবে।”

ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন। ডাক্তারেরা তাঁর তিরােধানের কথা ঘােষণা করলেন। মর্মভেদী আর্তি শােনা গেল সারদামণির কণ্ঠে ‘মা কালী, আমায় ছেড়ে তুমি কোথায় গেলে?” 9

দুঃখ শােকের দহন কিছুটা প্রশমিত হবার পর বিভিন্ন শিষ্যরা ভাবলেন, সারদামণিকে কিছু দিনের জন্য, কলকাতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে, এতে হয়তাে তাঁর হৃদয়-জ্বালা কিছুটা নিবারিত হতে পারে।

শুরু হল তীর্থভ্রমণ। সেখানেও মাঝে মধ্যে অলৌকিক ঘটনা ঘটে যেত। একবার যমুনায় নৌকো ভ্রমণকালে জলের দিকে তাকিয়ে সারদার মধ্যে মহাভাবের উদ্দীপনা হয়।

বৃন্দাবন, মথুরা, ব্রজমণ্ডলের তীর্থ দেখে হরিদ্বার, জৌনপুর, প্রয়াগ প্রভৃতি দর্শন করলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করে নিজের কেশদাম বিসর্জন দেবেন। কিন্তু মধ্যরাতে ঠাকুর স্বপ্নে দেখা দিয়ে কেশদাম বিসর্জন দিতে বারণ করেছিলেন। সারদামণি বুঝতে পারলেন, তাঁকে এইভাবে সালঙ্করা এবং কেশবতী হয়েই থাকতে হবে।

এই সময় তাঁকে নানাধরনের আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তিনি ধীরে ধীরে সেই সমস্যা সমাধান করেন। তখন থেকেই আরও বৃহত্তর কাজের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল সারদামণিকে। রামকৃষ্ণ ভাবাশ্রিত মানুষজন তাঁর কাছে এসে বসতেন। তাঁর মুখ-নিঃসৃত অমরবাণী শ্রবণ করতেন। কখনও কোনাে কলহ দেখা দিলে সারদামণি তা মিটিয়ে ফেলতেন। সকলে তাঁকে শ্রদ্ধা করত। তাঁর কথা মেনে চলত। এভাবেই তিনি রামকৃষ্ণ আশ্রমের নেত্রী হয়ে ওঠেন। সকলকে কাছে টেনে নিতেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ কোনাে কিছুর তােয়াক্কা করতেন না। এমনকি তথাকথিত বিধর্মীদেরও পাশে বসিয়ে খাওয়াতেন। নিজের হাতে তাদের এঁটো পরিষ্কার করতেন। এই ভাবে সারদামণি এক প্রগতিশীলা রমণী হয়ে ওঠেন।

ভক্তদের বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দিতেন। তাঁর কথা শুনে অশান্ত মন শান্ত হত। দহন জ্বালার প্রশমন ঘটে যেত। একবার সারদামণি বলেছিলেন। “কথায় আছে পুকুরে চাঁদের প্রতিচ্ছবি দেখে ছােটো ছােটো মাছেরা আনন্দে সেখানে লাফালাফি করে, খেলা করে, ভাবে আমাদেরই একজন। কিন্তু যখন চাঁদ অস্ত গেল, তখন আগের অবস্থা। লাফালাফির এল অবসাদ তারা কিছুই বুঝতে পারল না।”

আর একবার বলেছিলেন— “সেবা করতে করতে অধিকার পেয়ে অহম বুদ্ধি বেড়ে গেলে মানুষ তখন পুতুলের মতাে নাচতে চায়। উঠতে বসতে খেতে চায়। ভাবে, সে’ হল সবকিছুর কর্তা। অনেক মহাপুরুষের চারিদিকে ঐশ্বর্যের ভাব থাকে। তাই দেখে অনেকে তাদের সেবা করতে এসে ওতেই মত্ত থাকে, পরে এতেই ডুবে যায়।”

এইসব সাধারণ কথাগুলির অন্তরালে যে দার্শনিক অভীক্ষা লুকিয়ে আছে, তা হয়তাে আমরা বুঝতে পারি। তখন অবাক হয়ে ভাবি, সারদা মায়ের মতাে একজন তথাকথিত অল্পশিক্ষিতা রমণী দর্শনের এই বিষয়গুলিকে আত্মস্থ করলেন কী করে?

দিন কাটতে থাকে। জীবন-সূর্য এবার অস্তাচলের দিকে এগিয়ে চলেছে। ১৯২০ জয়রামবাটীতে বারবার জ্বরে ভুগে সারদামণির দেহ হয়ে উঠেছে। দুর্বল। ভক্তরা তাঁকে কলকাতায় নিয়ে এলেন চিকিৎসার জন্য। প্রাচীন এবং আধুনিক— দু’ধরনের চিকিৎসা করা হল। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। জানা গেল, মায়ের মারাত্মক কালাজ্বর হয়েছে। তখন শরীরে কোনাে ওষুধ কার্যকারী হল না।

সারদামণি বুঝতে পেরেছিলেন, এবার তাঁকে মহাকালের ডাকে সাড়া দিতেই হবে। এই নশ্বর দেহ ত্যাগ করে অমৃতলােকে মিলিয়ে যেতে হবে। উন্মুখ হয়ে আছেন তিনি লীলা সংবরণের জন্য।

এক শােকার্ত ভক্তকে সেদিন বললেন— “মনে হচ্ছে এই শরীর দিয়ে ঠাকুরের যা করবার ছিল, শেষ হয়েছে। এখন মনটা সদাই তাঁকে চায়, অন্য কিছু আর ভালাে লাগে না।”

তখনও তিরােধানের দিন সাতেক বাকি আছে। নিজের শয্যাপ্রান্তে স্বামী সারদানন্দকে ডাকিয়ে আনলেন, তাঁর হাতখানি ধরে বললেন— “সারদা, এরা রইল,- এবার সকলে বুঝতে পারলেন যে, শেষ সময় ক্রমশ এগিয়ে আসছে।

মা সারদামণি তখন একেবারে শয্যাশায়িনী, ডাক্তারের নিষেধে কাউকে রােগশয্যার পাশে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। একটি মেয়ে ঠাকুরঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে তাঁকে দর্শনের চেষ্টা করছে।

তাকে দেখে ক্ষীণ কণ্ঠে সারদামণি বললেন- “ভয় কীগাে? তুমি ঠাকুরকে দেখেছ, তােমার আবার ভয় কী?”

তারপর বললেন – “যদি শান্তি চাও মা, কারাের দোষ দেখ না। দোষ দেখবে নিজের। জগতটাকে আপনার করে নিতে শেখাে, কেউ পর নয়, মা, এ জগত তাে তােমার নিজেরই।”

ত্রিতাপদগ্ধ নরনারীর জন্য এই কটি কথাই তিনি শেষবারের মতাে বলেছিলেন। অন্তিম বাণীর প্রতিটি শব্দ এক আশ্চর্য দ্যোতনা বহন করছে। এইভাবে তিন দিন আত্মলীন অবস্থায় কেটে যায়। ১৯২০ সালের ২০ জুলাই নিশীথ রাতে চিরবিদায়ের ক্ষণটি ঘনিয়ে আসে। রােগক্লিষ্ট বিশীর্ণ আননে ফুটে ওঠে এক দিব্য জ্যোতির আভা। শেষবারের মতাে উদ্ভাসিত হয় মুখমণ্ডল। তারপর? তারপর তিনি নিমজ্জিতা হন মহাসমাধিতে। এই সমাধি আর কখনাে ভাঙেনি।

আরও পড়ুন –

শ্রীরামকৃষ্ণ – কালী- সাধক , ধর্মীয় গুরু ।

স্বামী বিবেকানন্দ- বীর সন্ন্যাসী, হিন্দু ধর্মের প্রচারক, সমাজ সংস্কারক, জাতীয়তাবাদী।

ভগিনী নিবেদিতা – স্বামী বিবেকানন্দের স্বনামধন্যা শিষ্যা,সন্ন্যাসিনী।

3 thoughts on “দেবী সারদামণি – সকলের মা, ধর্মপ্রাণা এবং সরল প্রকৃতির মানবী”

Leave a Comment