গৌতম বুদ্ধ
গৌতম বুদ্ধ বেদ ও বর্ণাশ্রম প্রভাবিত আর্য সমাজের প্রথম বিদ্রোহী সন্তান। বুদ্ধের জীবন কাব্য খুবই বর্ণময়। স্নেহময় পিতা, শান্তিপূর্ণ রাজ্য, সুন্দরী পত্নী, শিশুপুত্র চারিপাশে বিলাসবহুল জীবনযাত্রা—কিন্তু যুবক সিদ্ধার্থকে আকর্ষণ করল মানুষের দৈনন্দিন জীবনের মূল সমস্যা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রােগশােক, জরা-মৃত্যুর যে ভয়াল করাল গ্রাস সেই বাস্তব কঠোর রূপ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। বুঝেছিলেন দুঃখই সত্য, সুখ ক্ষণস্থায়ী। অবিরাম কলরােল তুলে, যে জীবন-স্রোত বহমান, সেই জীবনে কারােই পরিত্রাণ নেই। সিদ্ধার্থর মনে এক প্রশ্ন আলােড়িত হয়েছিল—কোথায় এর পরিত্রাণ? কিন্তু কোন পথে প্রাপ্তি হবে এর পরিত্রাণ ? দুঃখও আছে, কিন্তু দুঃখের নিবৃত্তি কোন পথের শেষে ? সেই মুক্তিপথের খোঁজে রাজ সিংহাসন, পত্নী, শিশুপুত্র সব পিছনে ফেলে সেই মহামানব পথে বের হয়েছিলেন।
একদা বৈশাখী পূর্ণিমায় শরৎকুমার গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন এবং তারপর থেকে এই পৃথিবীতে নতুন ধর্ম, নতুন নীতি, নতুন দর্শন ও সমাজ বিন্যাস কৌশল ভােগবিলাসী উদ্ধত ক্ষত্রিয় সমাজের আড়ম্বরপূর্ণ সমাজের মাঝে গৌতম বুদ্ধ সৃষ্টি করেছিলেন—এক অভূতপূর্ব প্রক্রিয়া। বেদ ও বর্ণাশ্রম প্রভাবিত সমাজ চমকে উঠেছিল তাঁর ধর্মাদর্শনে। প্রচলিত বিশ্বাস, গতানুগতিক । লােকাচারকে অস্বীকার করে বুদ্ধ বলেছিলেন—“আমি ঈশ্বর নই অথবা ঈশ্বরপ্রেরিত নই। আমি মানবসন্তান সাধনাবলে জেনেছি জন্ম ও মৃত্যু রহস্য।
জেনেছি, দুঃখ কি, জেনেছি দুঃখের কারণ এবং সেই কারণ দূর করার উপায়ও জেনেছি।”—এইভাবে সমাজরে ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল সব ব্যক্তিত্বই বুদ্ধের দ্বারা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাদের সকলের জীবনকেই বুদ্ধ চালিত করেছিলেন নতুন নির্মল বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন পথে—সকলকে আহ্বান করেছিলেন জীবনের প্রসারের পথে। ইতিহাসে বুদ্ধ যে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করেন, তার কারণ এই সবই। মানবচিন্তায় নিজেকে নিয়ােজিত করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ—সব ইতিহাস কিংবদন্তীর সীমানা অতিক্রম করে।
শাক্য রাজ্যের রাজা ছিলেন শুদ্ধোদন। কপিলাবস্তু ছিল সেই রাজ্যের রাজধানী। কলিপাবস্তু হিমালয়ের সানুদেশে অবস্থিত ছিল। শাক্যকুলের উপাধি ছিল গৌতম। মায়াদেবী ছিলেন রাজ্যের প্রধান মহিষী। মায়াদেবীর গর্ভে এক বৈশাখী পূর্ণিমায় লুম্বিনী উদ্যানে জন্মগ্রহণ করেন সিদ্ধার্থ। কিন্তু শিশু সিদ্ধার্থের জন্মের সাতদিন পরেই মৃত্যু হয় মায়াদেবীর। তাঁর সহােদরা ও সপত্নী মহাপ্রজ্ঞাবতী সিদ্ধার্থের মায়ের অভাব পূর্ণ করেছিলেন। উপযুক্ত সময়কালে কুমার সিদ্ধার্থের বিদ্যাভ্যাস আরম্ভ হয়। রাজ-আচার্যের কাছে সিদ্ধার্থ অধ্যায়ণ করেন বেদাদিশাস্ত্র, ধনুর্বিদ্যা ও রাজনীতি। তিনি মৃগয়া, অশ্বারােহণ, রথ চালনা ইত্যাদি বিদ্যাতেও ছিলেন যথেষ্ট পারদর্শী। এইভাবেই কুমার সিদ্ধার্থকে রাজা শুদ্ধোদন সবদিক দিয়ে উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর যােগ্য করেই প্রতিপালন করেছিলেন।
কৈশাের অতিক্রম করে যৌবনে পদার্পণ করেছিলেন কুমার সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থর ছিল বীরত্ব ব্যঞ্জক আকৃতি, কিন্তু তাঁর প্রকৃতি ছিল অতিশয় প্রশান্তি, প্রশান্তি সত্ত্বেও তিনি ছিলেন উদাস। রাজ্যের ভােগ-বিলাসিতা কোনাে কিছুই আকৃষ্ট করে না। রাজা শুদ্ধোদনের শত চেষ্টা সত্ত্বেও রাজকুমার সিদ্ধার্থ সবরকমের ভােগবিলাস থেকে দূরে থাকতেন। কৃষি হলােৎসবের দিনে সিদ্ধার্থকে এক জামগাছের নীচে ধ্যানস্থ অবস্থায় সবাই আবিষ্কার করেন। শুদ্ধোদনের স্মরণে আসে এক অমােঘ ভবিষ্যদ্বাণী। কুমার সিদ্ধার্থের জন্মের কিছু পরেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন—জগতের সমস্ত দুঃখ, ভারাক্রান্ত জনগণের ইনিই হবেন মুক্তিদাতা। আরােও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, এই রাজকুমার ভারী বুদ্ধ যিনি বহু যুগ পরে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
যখন কোনাে প্রকারেই রাজপুত্রের মন সংসারের প্রতি আকৃষ্ট করা গেল না, তখন মহাপ্রজ্ঞাবতী দেবীর পরামর্শে রাজা শুদ্ধোদন কুমার সিদ্ধার্থের বিবাহ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সিদ্ধার্থের তখন আঠারাে বছর বয়স। দণ্ডপাণির কন্যা যশােধারার স্বয়ংবর সভায় দেশ বিদেশের অন্যান্য রাজকুমারদের সঙ্গে সিদ্ধার্থও উপস্থিত হলেন এবং সকলের অবাক দৃষ্টির সামনে রাজকুমারীর বরমাল্য লাভ করলেন। সিদ্ধার্থের বিবাহের পরে নিশ্চিন্তবােধ করলেন শুদ্ধোদন। শুদ্ধোদন সিদ্ধান্ত নিলেন কয়েকদিন পরেই কুমার সিদ্ধার্থকে যুবরাজ হিসাবে ঘােষণা করার।
3 কিন্তু আকণ্ঠ ভােগ-বিলাস এবং নব্য বিবাহিত জীবন সত্ত্বেও সিদ্ধার্থর কোনাে কিছুর প্রতি আসক্তি ছিল না। এইভাবে দশ বছর অতিক্রান্ত হবার পরও কোনােভাবেই সংসারের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেননি রাজকুমার সিদ্ধার্থ। ততদিনে সিদ্ধার্থের এক পুত্র সন্তানও জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু শৃঙ্খলে আবদ্ধ হস্তীচিত্ত যেমন অরণ্যের প্রতি ব্যাকুল মনােভাব পােষণ করে, রাজপুত্র সিদ্ধার্থও তেমনই সংসারের মায়ার বন্ধন কাটাতে ব্যগ্রবােধ করেছিলেন। এরই মধ্যে উপর্যুপরি চারদিন নগর ভ্রমণে বেরিয়ে সিদ্ধার্থ একে একে দর্শন করলেন একটি পকেশ বৃদ্ধ, ব্যাধিগ্রস্ত একটি মানুষ, একটি মৃতদেহ—এইভাবেই জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুকে উপলব্ধি করলেন কুমার সিদ্ধার্থ। একদিন তাঁর সাক্ষাৎ হল এক দেবদর্শনধারী সন্ন্যাসীর সাথে। এই সন্ন্যাসীই সিদ্ধার্থকে বােঝালেন যে, সিদ্ধার্থই। হলেন বােধিসত্ত্ব জগতকে ধর্মের নতুন আলােয় আলােকিত করার জন্যেই জন্ম হয়েছে সিদ্ধার্থের। তারপরই সিদ্ধার্থ মনে মনে সিদ্ধান্তলাভ করেন গৃহত্যাগের জন্য। এক চৈত্র পূর্ণিমার নিঃস্তব্ধ রাত্রে নিদ্রিত পত্নী যশােধরা এবং নিদ্রিত পুত্র রাহুলকে পিছনে ফেলে মহাজীবনের অনন্ত পথে অগ্রসর হলেন কুমার সিদ্ধার্থ।
এর পরেই সৌম্যমূর্তি সিদ্ধার্থ গৌতম কখনাে বৈশালী, কখনাে শ্রাবস্তীর পথে পদব্রজে ভ্রমণ করেছেন—হাতে তাঁর ভিক্ষাপাত্র। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ তখন শিক্যমুনি। অনন্ত নির্বাণপথের পথিক শাক্যমুনি সিদ্ধার্থ। পথ চলার সময়ে যত তপস্বী সাধুর সংস্পর্শে আসেন তিনি তাঁদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে আহরণ নতুন নতুন ধর্ম জ্ঞান ও মতাদর্শ নানা বিষয় জ্ঞান অর্জন করেনকর্ম, জন্মান্তর, ঈশ্বরতত্ত্ব, আত্মস্বরূপ এবং শাস্ত্রের আরও কত নিগূঢ় তত্ত্ব। পাশাপাশি চলে কঠোর সাধনা। এক সময়ে শ্রাবস্তী ছেড়ে তিনি চলে আসেন বিম্বিসারের রাজগৃহে। আরও শ্রেষ্ঠতর সাধনার উদ্দেশ্যে এক সময় তিনি রাজগৃহ ত্যাগ করে আসেন উরুবিম্বে (বর্তমান নাম বুদ্ধগয়া)। বুদ্ধগয়াতেই এক নির্জন অন্তঃসলিলা নদীর পশ্চিমতটে এক প্রাচীন বটবৃক্ষের তলায় গৌতম শুরু করেন তাঁর নিবিড় সাধনা। ক্রমে উপবাসে ও অনাহারে জীর্ণ এবং শীর্ণ হয় তাঁর শরীর। তথাপি চলে সাধনা।
জীবনে কাঙ্ক্ষিত সত্যের সন্ধানে চলে সিদ্ধার্থের কঠোর সাধনা। অবশেষে বৈশাখের উজ্জ্বল পূর্ণিমায় কঠোর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন গৌতম সিদ্ধার্থ। এই সিদ্ধিলাভের ফলে তাঁর মন ক্রমশ উপনীত হয় ধ্যানের স্তর অতিক্রম করে। সুখ-দুঃখের অতীত, স্মৃতি-পরিশুদ্ধময় চতুর্থ স্তরে। এই প্রকারেই উন্মােচিত হয় জন্ম-জন্মান্তরের রহস্য যবনিকা। এরপর আয়ত্ব হয় দ্বিতীয় বিদ্যা—চ্যুততাৎপত্তি জ্ঞান। উদ্ঘাটিত হয় জন্ম-মৃত্যু রহস্য। তৃতীয় স্তরে তিনি লাভ করেন জগতের স্বরূপ। চতুর্থ স্তরে সাধনাপ্রসূত বুদ্ধত্ব লাভ করে ভগবান বুদ্ধ বিপুল আনন্দোচ্ছাসে নৈরঞ্জনা সৈকত প্রতিধ্বনিত করেন—“সংস্কার বিগতবিত্ত, তৃষ্ণা আজি পাইয়াছে ক্ষয়।” সেই শেষ স্তরে কার্য-কারণ-শৃঙ্খলা বিলােকন করে, দুঃখের মূল-তত্ত্বে উপনীত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। দুঃখের দ্বাদশ নিদান হয় আবিস্কৃত। এই ছিল গৌতম বুদ্ধের প্রকৃত জীবন-দর্শন।
এর অব্যবহিত পরে গৌতম বুদ্ধ ব্রতী হন তাঁর সাধনালুব্ধ জ্ঞান প্রচারে। বারাণসীর উত্তরে অবস্থিত সারনাথ থেকে আরম্ভ হয় তাঁর ধর্ম প্রচার। পাহাড়ের উপর অবস্থিত সারনাথ একদা বৌদ্ধধর্মানুশীল এবং জ্ঞানচর্চার প্রাণক্ষেত্র ছিল। বুদ্ধদেব সারনাথেই মৃগদাহে সর্বপ্রথম পঞ্চশিষ্যের নিকট ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছিলেন। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল বুদ্ধবাণী। বৌদ্ধ ধর্মচক্রে আকৃষ্ট হন বহু মানুষ। তারপর একদা গৌতম বুদ্ধ ষাটজন ভিক্ষুককে একত্র করে বললেন, তােমরা বহুজনহিতায় বহুজন সুখায় লােকানুকম্পায় হয়ে পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য ঘুরে বেড়াও—এই ছিল ধর্ম প্রচার হেতু বুদ্ধের প্রথম নির্দেশ।
বুদ্ধত্বলাভের পর প্রায় অর্ধশতাব্দী সময় ধরে তিনি প্রচার ব্রতে লিপ্ত ছিলেন। বহুজনপদ ভ্রমণ করে বুদ্ধদেব বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিলেন। বুদ্ধদেব ইতিহাসের সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি ধর্মকে প্রচারের বিষয় করে তুলেছিলেন। ধণী, দরিদ্র, নির্বিশেষে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর অনুকম্পা।
অবশেষে আশি বছর বয়সে এক বৈশাখী পূর্ণিমা রাত্রে কুশীনগরে হিরণ্যবতী নদীতীরে শালবৃক্ষমূলে বুদ্ধদেব মহাপরি নির্বাণ শয়নে শায়িত হলেন।
বুদ্ধদেব ছিলেন মহাপুরুষ। মানবকল্যাণ সাধনই ছিল তাঁর একান্ত কাম্য। সমগ্র মানব জাতির উদ্ধার সাধনই ছিল তাঁর জীবনের সংকল্প। পরম প্রেম, সর্বদর্শী, শক্তি, শ্রেষ্ঠ জ্ঞান আর পূর্ণ পবিত্রতা—এই ছিল বুদ্ধমানসের প্রধান উপাদান। বুদ্ধদেবের ন্যায় অজাতশত্রু মহামানব এই পৃথিবীতে আর জন্মগ্রহণ করেন নাই। বুদ্ধদেব মহাজ্ঞানী ছিলেন কিন্তু জ্ঞানের গরিমা প্রকাশ হার স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। সরলতা, উদারতা আর সৎ চেষ্টা—বুদ্ধচরিত্রের এইগুলি ছিল মূল উপাদান। বুদ্ধদেব তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবন অতিবাহিত করেছিলেন মানবহিতার্থে। বুদ্ধের অসামান্য অবদান হলাে সংঘ আর সামাজিক সাম্য। মানবমনের সিংহাসনে গৌতম বুদ্ধের আসন শাশ্বত। তাই আজও মানবমনের গভীর হতে উচ্চারিত হয় প্রার্থনা
“শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্ত পূণ্য
করুণাঘন ধরণীতল কর কলঙ্কশূন্য।”
আরও পড়ুন –
2 thoughts on “গৌতম বুদ্ধ – বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা , মুক্তির দিশারী।”