করুণাসাগর বিদ্যাসাগর
বিদ্যাসাগরের মততা স্বাধীন চেতনা এবং কর্মোদ্যগী বাঙালি খুব একটা বেশি চোখে পড়ে না। এক জীবনে তিনি যেসব দিকচিহ্ন রেখে গেছেন, তার সঠিক মূল্যায়ন হয়তাে এখনও সম্ভব হয়নি।
বিদ্যাসাগর একাধারে ছিলেন শিক্ষাব্রতী, সমাজ সংস্কারক এবং বাংলা গদ্যসাহিত্যের অন্যতম জনক।
বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়েছিল ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর। তিনি জন্মেছিলেন মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে। তাঁর আসল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মা হলেন ভগবতী দেবী।
ছােটো থেকেই বিদ্যাসাগর ছিলেন অত্যন্ত জেদি স্বভাবের শিশু। তাঁর জন্ম সম্পর্কে একটি সুন্দর গল্প আছে। ঠাকুরদাস হাট থেকে ফিরতেই বাবা বললেন“তরে আমাদের একটি এঁড়ে বাছুর হয়েছে।”
ঠাকুরদাস তাড়াতাড়ি নতুন বাছুর দেখার জন্য গােয়ালের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বাবা, বললেন—“ওদিকে নয়” এই বলে তিনি আঁতুড় ঘর দেখিয়ে দিলেন। ঠাকুরদাস প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। পরে বুঝতে পারলেন।
আঁতুড় ঘরে গিয়ে দেখলেন স্ত্রী ভগবতী দেবীর কোল জুড়ে একটি ফুটফুটে ছেলে শুয়ে রয়েছে। এই শিশুই হলেন বিদ্যাসাগর।
এঁড়ে বাছুরের মতােই একগুঁয়ে ছিলেন সেদিনের শিশু বিদ্যাসাগর। যখন যা চিন্তা করতেন সেটাকে কাজে পরিণত করতেন।
যেটাকে ভালাে বলে মনে করতেন তাঁর জন্য জীবন দিতে পারতেন। পরবর্তী কালেও তাঁর এই জেদি স্বভাবের কোনাে পরিবর্তন হয়নি।
ছেলেবেলায় খুবই দুরন্ত ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। কালাে বেঁটে এই ছেলেটির দৌরাত্ম্যে বাড়ির লােক অতিষ্ঠ হয়ে উঠত।
তবে পড়াশােনাতে মাথাটা ছিল খুবই পরিষ্কার। অল্প সময়ের মধ্যেই গুরুমশায়ের পাট শেষ করে ফেলতেন।
ঠাকুরদাসের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালাে ছিল না। কোনাে রকমে কায়ক্লেশে সংসার চলে যেত। তবু ঈশ্বরচন্দ্রকে ঘিরে তাঁর মনে ছিল অনেক স্বপ্ন।
তিনি চেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র যেন ভালাে করে লেখাপড়া শেখে। ঠাকুরদাস চাকরি করতেন কলকাতায়। ছেলেকে নিয়ে চললেন কলকাতায় উচ্চশিক্ষা দেবার জন্য।
তখনকার দিনে রেলগাড়ি ছিল না। বীরসিংহ থেকে কলকাতার দূরত্ব খুব একটা কম নয়। ছেলের হাত ধরে ঠাকুরদাস হাঁটতে হাঁটতে চললেন শহরের দিকে।
বাবার সঙ্গে পথ চলছেন সেদিনের বালক ঈশ্বরচন্দ্র। মাইলের পর মাইল অতিক্রম করছেন। পথের ধারে মাইলের সংখ্যা লেখা পাথরের ফলক পোঁতা আছে। ন’বছরের ছেলে জানতে চাইলেন, “বাবা, এগুলাে কি?”
ঠাকুরদাস বললেন—“এগুলােকে বলা হয় মাইলপােস্ট, কলকাতা এখান থেকে কত মাইল দূরে, এই পােস্ট দেখলে আমরা তা বুঝতে পারি।”
ঈশ্বর একথা শুনে খুবই অবাক হয়ে গেলেন। তাঁর শিশুমন কৌতূহলী হয়ে উঠল। তিনি খুব ভালাে করে মাইল পােস্টগুলি নজর করতে লাগলেন। এইভাবে হাঁটা পথে কলকাতায় যেতে যেতে তিনি ইংরাজি সংখ্যাগুলি চিনে ফেলেছিলেন।
কলকাতায় গিয়ে ঠাকুরদাস ঈশ্বরকে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করে দিলেন। ঈশ্বরকে কিন্তু খুব দুঃখকষ্টের মধ্যে থেকে পড়াশােনা চালাতে হয়েছে। সারাদিন তাঁকে একা হাতে সংসারের হাজার কাজ সামলাতে হত।
বাসনও মাজতে হত, রান্না করতে হত। তারই মাঝে পড়াশােনা। অল্পদিনের মধ্যে ঈশ্বর সাহিত্যিক, অলঙ্কার, ব্যাকরণ, স্মৃতি এবং অন্যান্য বিষয়গুলি ভালােভাবে আয়ত্ত করে ফেললেন।
পরীক্ষা দিয়ে সকলের থেকে বেশি নম্বর পেলেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তাঁকে পণ্ডিতেরা বিদ্যাসাগর” উপাধি দিয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগর এই সময় শহর কলকাতার বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফোর্ট উইলিয়ামে চাকরি পান। বাবাকে বললেন—“বাবা, তুমি অনেকদিন পরিশ্রম করেছ। তােমাকে আর চাকরি করতে হবে না। আমার মাইনেতে সংসার চলে যাবে।”
ছেলের কথায় ঠাকুরদাস চাকরি ছেড়ে দিয়ে বীরসিংহ গ্রামে চলে গেলেন। অবসর জীবন যাপন করতে লাগলেন। আর ঈশ্বরচন্দ্র চাকরি করে সংসার চালাতে লাগলেন।
একবার তাঁর মনে ইচ্ছে হল মাকে গয়না গড়িয়ে দেবেন। মাকে বললেন “মা” তুমি কী গয়না নেবে বলাে?”
ভগবতী দেবী ছিলেন অত্যন্ত নিরাহঙ্কার রমণী। নিজের জন্য কখনাে কোনাে কিছু ভাবতেন না। তিনি বললেন—“আমি তােমার কাছে তিনটি গয়না চাইছি বাবা।
গ্রামের ছেলেদের জন্য একটি স্কুল, মেয়েদের জন্য আর একটি স্কুল আর গরিবদের জন্য ডাক্তারখানা—এই তিনটি গয়না পেলেই আমি খুশি হব।
বিদ্যাসাগর মায়ের এই উদার মনের পরিচয় পেয়ে, অবাক হয়ে গেলেন। সত্যিই তাে, ভগবতী দেবী ছিলেন এমনই নিঃস্বার্থপর। আর মায়ের কাছ থেকে এই গুণটি বিদ্যাসাগর পেয়েছিলেন।
১৮৪১ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেড পণ্ডিতের পদ লাভ করলেন। বিদ্যাসাগর এই কলেজে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় রেখেছিলেন।
তাঁকে বাংলা গদ্যের জনকও বলা হয়। তিনি স্কুল বিভাগের জন্য বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লেখা বর্ণপরিচয় পড়েননি এমন বাঙালি বােধহয় একজনও নেই।
এছাড়া তিনি বােপােদয়, কথামালা, চরিতাবলী লিপিপাঠ প্রভৃতি লিখেছিলেন। বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, সীতার বনবাস ইত্যাদি রচনা করেন।
সম্পাদন করেন রঘুবংশ, সন্দর্ভ সংগ্রহ, কুমারসম্ভব, কাদম্বরী, মেঘদূত, উত্তর রাম চরিত, অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রন্থগুলি।
যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটা বাঙালির গর্বের অন্ত ছিল না সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
চিরদিন লড়াই করেছেন সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তিনি বিধবা বিবাহ প্রথাসিদ্ধ । করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাঁর সারা জীবনের চেষ্টায় শেষ অবধি বিধবা বিবাহ সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে বলেছেন—“তিনি হিন্দু ছিলেন না, বাঙালি বা ব্রাহ্ম ছিলেন না। ছিলেন মানুষ।”
রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন—“তাঁর মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয় বট তিনি বঙ্গ ভূমিতে রােপণ করিয়াছেন তাহার তলদেশ জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে।”
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর মন্তব্যটি একবার শুনে নেওয়া উচিত। মহাত্মা গান্ধী মন্তব্য করেছেন—“আমি যে দরিদ্র বাঙালি ব্রাহ্মণকে শ্রদ্ধা করি, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।” ।
১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই একাত্তর বছর বয়সে বিদ্যাসাগরের মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন –
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য | কিশোর কবি | বিশিষ্ট সাহিত্যিক | Sukanta Bhattacharya
1 thought on “করুণাসাগর বিদ্যাসাগর – বাংলার গর্ব , দামোদরের রাজপুত্র, মেদিনীপুরের সন্তান।”