জগদীশচন্দ্র বসু – বিজ্ঞানসাধক, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী

জগদীশচন্দ্র বসু

জগদীশচন্দ্র বসুকে আমরা ভারতের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী বলতে পারি। শুধু বিজ্ঞানী নয়, সর্বার্থে তিনি ছিলেন বিজ্ঞানসাধক, সাধারণ বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের কোনাে একটি শাখা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

জীবনব্যাপী সাধনার মাধ্যমে নিত্যনতুন আবিষ্কার করে মানবজাতির কল্যাণ সাধন করেন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞানের একাধিক শাখায় তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

তিনি ছিলেন একাধারে উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এবং পদার্থ বিজ্ঞানী, এমন ঘটনা বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে খুব বেশি ঘটে না।

অনেকে বলে থাকেন জগদীশচন্দ্র বসুর দুর্ভাগ্য যে, তিনি তাঁর সময় সীমার আগেই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ তাঁর প্রতিভার মূল্যায়ণ সেই সময় হয়নি।

আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা নতুনভাবে জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণা সম্পর্কে আলােচনা করেছেন। এটাই বােধহয় ভারতবাসী হিসাবে আমাদের পরম গৌরবের বিষয়।

ব্যক্তিগত জীবন –

জগদীশচন্দ্রর জন্ম হয়েছিল ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর। তাঁর পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। পিতার চরিত্রের কতগুলি গুণ জগদীশচন্দ্র একেবারে শৈশব থেকে আত্মস্থ করেছিলেন।

তাঁর পিতার মধ্যে ছিল স্বদেশপ্রেম। তিনি সমস্ত মানুষকে একই রকমভাবে ভালােবাসতেন। কত বড়াে সরকারি চাকুরে হওয়া সত্ত্বেও সমাজের শ্রমজীবী মানুষদের প্রতি সমবেদনা এবং করুণা দেখিয়ে গেছেন।

এই বােধ জগদীশচন্দ্রকেও প্রভাবিত করেছিল। পিতার কাছ থেকেই জগদীশচন্দ্রের ছােটবেলার শিক্ষা শুরু। হয়। জগদীশচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল একটা সহজাত বৈজ্ঞানীক প্রতিভা নিয়ে।

তাই বােধ হয় প্রকৃতির খেয়ালি খেলাঘরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তিনি নানা বিষয় দেখে অবাক হতেন এবং বাবার কাছে সেইসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইতেন।

বাবা সহজভাবে এবং সহজ ভাষায় উত্তর দিয়ে জগদীশচন্দ্রের জ্ঞানপিপাসা তৃপ্ত করেছিলেন। একেবারে ছােটবেলা থেকে জগদীশচন্দ্রের মনের ভেতর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার জন্ম হয়েছিল।

শিক্ষাজীবন –

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তদানীন্তন নিয়ম অনুযায়ী গ্রামের পাঠশালায় জগদীশচন্দ্রের শিশুশিক্ষা শুরু হয়। বিদ্যালয়ের পরিবেশ তাঁর খুব একটা ভালাে লাগেনি। তবে পড়াশােনাতে তিনি ছিলেন মনোেযােগী ছাত্র।

তাই শিক্ষকেরা তাঁকে খুব ভালােবাসতেন। সহপাঠীদের সঙ্গেও ছিল তাঁর সুন্দর সখ্যতার সম্পর্ক। সংক্ষেপে বলা যায় জগদীশচন্দ্রের শিশু শিক্ষার পরিবেশ ছিল খুবই স্বাস্থ্যপ্রদ।

এর পাশাপাশি তাঁর ঠাকুরমার কথা বলা উচিত। তাঁর ঠাকুরমা ছিলেন একজন ধর্মপরায়না মহিলা। তিনি রাতে প্রদীপ জ্বেলে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন অংশ তাঁর সুরেলা কণ্ঠস্বরে পাঠ করে শােনাতেন।

জগদীশচন্দ্র এইগুলি পড়তে পড়তে কোন ভাবজগতে চলে যেতেন। ন’বছরের বালক জগদীশচন্দ্র এলেন শহর কলকাতায়। কলকাতাতে এসে এখানকার বিরাট বাতাবরণ দেখে তিনি একেবারে অবাক হয়ে গেলেন।

তাঁকে ভর্তি করা হল সে যুগের এক নামকরা বিদ্যাকেন্দ্র হেয়ার স্কুলে। এখানে তিন মাস পড়ার পর তাঁকে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে চন্দ্র ছাত্রাবাসে থাকবেন।

তখনকার জীবনী ছিল নিয়ম শৃঙ্খলাতে ভরা। বিরাট শহরে অনেক কিছু তাঁকে অজানা আকর্ষণে ডাক দিত, তিনিও জনারণ্যে হারিয়ে যাওয়ার বাসনা পােষণ করতেন। কিন্তু নানা কারণে তাঁদের এই স্বপ্ন সফল হয়নি।

যােলাে বছর বয়সে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করলেন। এলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখানে ফাদার লাফো পড়াতেন প্রকৃতি বিজ্ঞান। তাঁর কাছে পড়তে পড়তে জগদীশচন্দ্র তন্ময় হয়ে যেতেন।

এর পাশাপাশি ওই ভদ্রলােক পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখাতেন। ওই ভদ্রলােকের সাহচর্য এবং সান্নিধ্যে জগদীশচন্দ্র উদ্ভিদ বিজ্ঞান এবং পদার্থ বিজ্ঞানের মত আপাত বিরােধী দুটি বিষয়ে আকৃষ্ট হলেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক হলেন জগদীশচন্দ্র। এবার তাঁকে এই সময় নিওলাইট সারপেনটাইন প্রভৃতি পাথরে বৈদ্যুতিক কম্পন পরিবর্তন করার পদ্ধতি মানুষ জেনে ফেলেছিল।

কিছুদিন বাদে লণ্ডনে দি ইলেকট্রিসিয়ান নামে একটি বিখ্যাত পত্রিকাতে এই বিষয়ে জগদীশচন্দ্রের দুটি মৌলিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হল।

ওই বছরের শেষের দিকে বিলেতে রয়্যাল সােসাইটি তাঁর গবেষণার পাওয়া ফল প্রকাশ করতে রাজি হয়। এমনকি তারা জগদীশচন্দ্রকে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য করতে থাকে যাতে অর্থের অভাবে তাঁর গবেষণার কাজ পরিত্যক্ত না হয়।

তাঁর গবেষণাকে ওই সংগঠন এতই গুরুত্ব দিয়েছিল যে, কোনাে পরীক্ষা না দেওয়া সত্ত্বেও তাঁকে সাম্মানিক ডি.এস.সি উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়।

কর্মজীবন –

প্রসঙ্গত বলা যায় তাঁর আগে আর কোনাে ভারতীয় বিজ্ঞানী এইভাবে সম্মানিত হননি।

১৮৯৬ সালে তিনি বিলেতে গেলেন। সেখানকার বিজ্ঞানীরা তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন। সেবার তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী লেডি অবলা বসুও গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত বিদুষী মহিলা।

এতেই বােঝা যায় যে জগদীশচন্দ্রের গবেষণার গুরুত্ব ছিল ওই বছর লিভারপুরে ব্রিটিশ অ্যাসােসিয়েশনের একটি বিশেষ অধিবেশনে জগদীশচন্দ্র বসুকে আমন্ত্রণ করা হয়।

সেখানে গিয়ে তিনি বিদ্যুত্রশ্মি সম্বন্ধে তাঁর যন্ত্রপাতি সকলের সামনে দেখালেন। ওই অধিবেশনে বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী অধ্যাপক কেলভিন তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকার পাতায় পাতায় জগদীশচন্দ্রের গবেষণালব্ধ বিষয়গুলি প্রকাশিত হল। রয়াল ইনস্টিটিউট থেকে আমন্ত্রিত হলেন বক্তৃতা দেবার জন্য।

সেখানে সহজ সাবলীল ভাষায় পদার্থবিজ্ঞানের নানা প্রকতি এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলােচনা করলেন। এই ভাষণে তিনি বলেছিলেন বিজ্ঞানকে যেন কয়েকজন বিজ্ঞানী কুক্ষিগত করে না রাখেন।

আসলে বিজ্ঞান হল সমস্ত মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়।

এবার তাঁকে ফ্রান্সে এবং জার্মান দেশে যাবার জন্য আমন্ত্রণ করা হল। ইউরােপের বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা দেবার পর ১৮৯৭ সালে জগদীশচন্দ্র স্বদেশে ফিরে এলেন।

দেশে ফিরে আবার নতুন নতুন ভাবে কাজ করতে শুরু করলেন। ১৯০০ সালে আরও একবার ইউরােপে গিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র।

সেই বছর প্যারিসে একটি শিল্প প্রদর্শনী হয়েছিল। এই উপলক্ষেবিদেশের বিভিন্ন দেশের বৈজ্ঞানিকদের ডেকে পাঠানাে হল। ভারত সরকার এই বিজ্ঞানসভায় জগদীশচন্দ্রকে পাঠিয়েছিলেন তাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধি করে।

প্যারিস থেকে জগদীশচন্দ্র লণ্ডনে এলেন। সেখানে এসে ব্রিটিশ আর্ট অ্যাসােসিয়েশন ব্ল্যাক বাের্ডের সভায় তাঁর ভাষণ পাঠ করলেন। সেখানে উপস্থিত পদার্থ বিজ্ঞানীরা তাঁকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেন।

কিন্তু শারীর বিজ্ঞানীর কোনাে কথা বললেন না। জগদীশচন্দ্রের মতাে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁদের স্বীকৃতির প্রয়ােজন ছিল। কারণ তিনি যে নতুন তথ্যটি উত্থাপন করেছেন সেটি পদার্থবিদ্যা ও শরীরবিদ্যার দুটি শাখার সঙ্গে যুক্ত।

জগদীশচন্দ্র প্রমাণ করেছিলেন যে বৈদ্যুতিক উত্তেজনায় জড় এবং জীব একইরকমভাবে সাড়া দিতে পারে। তবে জড়ের সাড়া দেবার ধরনটা প্রত্যক্ষ এবং জীবের ক্ষেত্রে অপ্রত্যক্ষ।

১৯০৩ সালের শেষের দিকে জগদীশচন্দ্র সাতটি প্রবন্ধ লিখে রয়্যাল সােসাইটিতে পাঠালেন। এরপর তিনি তিনবছর ধরে নানা বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালান এবং এই পরীক্ষালব্ধ ফলাফল নিয়ে দুটি বিরাট বই লিখে ফেলেন।

১৯০৬ সালে তাঁর উদ্ভিদের সাড়া’ এবং ১৯০৭ সালে তার তুলনাস্থলন বিদ্যুতিক শারীরবিদ্যা নামে দুটি বই প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি ইতিমধ্যে আরও একটি বই লিখে ফেলেছেন—“জীব এবং জড়ের সাড়া। =

জগদীশচন্দ্র প্রমাণ করতে চাইলেন যে, উদ্ভিদকে আমরা মৃতপ্রায় বলে মনে করি। কিন্তু আসলে তা নয়।

মানুষের মধ্যে যেমন নানা ধরণের আবেগ উৎকণ্ঠ ভালােবাসা উল্লাস অনুরাগ বিষন্ন তার জন্ম হয়, উদ্ভিদের মধ্যেও তেমনই একইভাবে এইসব মানসিক গুণগুলির প্রকাশ ঘটে।

তবে উদ্ভিদের ক্ষেত্রে প্রত্যাঘাতটি জীবের মত অত সহজ এবং প্রত্যক্ষ হয় না।

১৯০৭ সালে জগদীশচন্দ্র আর একটি বৈজ্ঞানিক অভিযানে পাশ্চাত্য দেশে এলেন। ইংল্যাণ্ড এবং আমেরিকা ঘুরে তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফলগুলির সকলের সামনে তুলে ধরলেন।

১৯১৪ সালে চতুর্থ অভিযানে তিনি কৃতকার্যতা লাভ করেন। এইভাবে তিনি বিশ্ববাসীর সামনে ভারতের লুপ্তপ্রায় বিজ্ঞান পরম্পরাকে আবার তুলে ধরেছিলেন।

১৯১৭ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর অনেকদিনের স্বপ্ন সফল হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বসু বিজ্ঞান মন্দির। তেইশ বছর আগে জগদীশচন্দ্র যে সঙ্কল্প গ্রহণ করেছেন, শেষ পর্যন্ত তা রূপায়িত হল।

জগদীশচন্দ্রের এই মহাপ্রয়াসের কথা আজও আমাদের মনে পড়ে, আজও এই সংগঠনটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এবং এখানে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর যে কী ধরণের কাজ হচ্ছে তা চোখে দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

জগদীশচন্দ্র, মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞান সার্বজনীন এবং সর্বত্র তার বাণী প্রচার করতে হবে। বেশিরভাগ বিজ্ঞানী বৈজ্ঞানীক পরীক্ষাগুলিকে নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি রাখতে চান, এমনকি হওয়া কখনােই উচিত নয়।

জগদীশচন্দ্রকে অনেকে প্রাচীন ভারতের ঋষির সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। জীবন সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত নিঃস্পৃহ ছিলেন।

তাই আজ আমরা টেলিভিশন আবিষ্কর্তা হিসাবে ইতালির বিজ্ঞানী মার্কনির নাম শুনতে পাই কারণ জগদীশচন্দ্র এই বিষয়ে উপযুক্ত পেটেন্ট করেননি।

শেষজীবন –

১৯২৮ সালে জগদীশচন্দ্র শেষবারের মতাে ইউরােপে গেলেন। রােমা রােলাঁ এবং বার্ড শ তাঁকে সংবর্ধিত করলেন। ১৯৩৭ সালের ২৩ শে নভেম্বর এই মহান বিজ্ঞানীর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।

 

আবদুল কালাম – মিশাইলম্যান, আধুনিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী।

চন্দ্রশেখর বেঙ্কটরামন | নোবেলজয়ী, স্বনামধন্য পদার্থবিজ্ঞানী | রামন এফেক্টের আবিস্কারক। C. V. Raman

2 thoughts on “জগদীশচন্দ্র বসু – বিজ্ঞানসাধক, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী”

Leave a Comment