ঝলমল সিং
অসমঞ্জ মুখােপাধ্যায়
রাজার রাজ্যটা ছােটো, কিন্তু রাজার নামটা খুব বড়াে। রাজার নাম—শ্রীল শ্রীগুরু শ্রীমদ্ধর্মাচার্য সপ্তেন্দ্রমুকুটমণি অসুরজিৎ দুর্ধর্ষনারায়ণ বাহাদুর। তবে সব লােকে তাঁকে দুর্ধর্ষনারায়ণ নামেই সম্বােধন করে থাকে। রাজার শালা—অর্থাৎ রানির ভাই, রাজভােগে রাজআশ্রয় রাজবাড়িতেই থাকেন।
রাজসংসারে রাজভােগে থাকলেও নগদ কিছু হাত খরচের দরকার। রানি রাজাকে ধরলেন—ঝলমলকে একটা কাজে বহাল করে কিছু বেতনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। শুধু খায়দায় আর বসে থকে, এ তাে ভালাে কথা নয়।
রাজা ঝলমল সিংকে আস্তাবলের তদারকির ভারার্পণ করলেন। বেতন মাসিক একশাে তঙ্কা।
আস্তাবলে রাজার খুব সুন্দর কুড়িটা ঘােড়া থাকত। তাদের দেখাশােনা আর পরিচর্যার জন্য পাঁচজন সহিস ছিল। ঘােড়াদের খােরাকের জন্যে রােজ বিশমন দানাপুরী ছােলার বরাদ্দ।
খােরাক আর পরিচর্যার গুণে কুড়িটা ঘােড়া হৃষ্টপুষ্ট আর তেজীয়ান। তাদের পেছনে সহিসরা খুবই খাটত; বহুদিনের রাজসহিস তারা।
এখন ঝলমল সিংয়ের ওপর আস্তাবলের সমস্ত দেখাশােনার ভার পড়ল। সকলে ভাবল, একেই তাে ঘােড়াগুলাে সুন্দর আর শক্তিশালী, এইবার তার ওপর রাজশ্যালকের তদারকিতে তারা আরও সুন্দর ও শক্তিশালী হবে, হয়তাে একদিন পক্ষীরাজ হয়ে গিয়ে সগগে উড়ে যাবে…কিন্তু হল তার বিপরীত।
ঝলমল সিংয়ের তদারকিতে উলটো হতে লাগল। অমন চমৎকার ওই ঘােড়াগুলাে দিনের পর দিন রােগা ও শক্তিহীন হয়ে যেতে লাগল। রাজা ব্যাপার দেখে সহিসদের তলব করলেন।
সহিসরা বলল, “হুজুর, ভয়ে বলব, না নির্ভয়ে বলব?
রাজা বললেন, ‘নির্ভয়ে বলাে।
তখন তারা বলল, হুজুর। বরাবর ঘােড়ারা পয়লা নম্বর দানাপুরী ছােলা খেয়ে আসছে; এখন শালাবাবু পচা, পােকাধরা ছােলা দেবার ব্যবস্থা করেছেন।
সে সব ছােলার খােসাই সার, ভেতরে সার কিছু নেই। তা অমন সব ঘােড়া উপযুক্ত মতাে খেতে না পেয়ে, দিন দিন হাড্ডিসার হয়ে আসছে, আমরা গরিব মানুষ কী করতে পারি বলুন।
রাজা অন্য লােক দিয়ে খোঁজ নিলেন। ঠিক তাই-ই বটে। ঝলমল সিং নির্বিকারে এই কাজ থেকে মাসে পাঁচ-সাতশাে টাকা অসদুপায়ে অর্জন করেছে।
তখন রাজা ঝলমল সিংকে আস্তাবল তদারকির কাজ থেকে ছাড়িয়ে আনলেন। ওকে অন্য কোনাে কাজে নিযুক্ত করতে হবে। সুতরাং রাজা এবার তাকে রাজ্যের সব বাজার তদারকের কাজের আদেশ দিলেন। বেতন তাই থাকল।
ঝলমল সিং উঠে পড়ে বাজার তদারকির কাজে লেগে গেলেন।
কয়েকটা দিন পরেই, সব জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করল, আর চাল, ডাল, তেল, ঘি, মাখন প্রভৃতিতে ভেজাল চলতে লাগল। ক্রমে প্রতিটি খাদ্যবস্তুর দাম আকাশছোঁয়া হয়ে উঠল আর ভেজাল উঠল একেবারে চরমে।
শেষে এমন হল যে, ভেজালটাই যেন মূল জিনিস, আর তাতে কিছুটা আসল মেশানাে। এর জন্যে প্রজাদের মধ্যে ঘাের অসন্তোষের সৃষ্টি হল; রাজ্যময় হইহই পড়ে গেল।
ঝলমল সিং নির্বিকার, তাঁকে ডাকিয়ে জিজ্ঞাসা করা হল, এরকমটা হবার কারণ কী?
ঝলমল বলল, “কিছুই তাে জানি না; আমি তাে সাধ্যমতাে তদারকি করে আসছি।’
তখন রাজা বাজারের ফোড়ে ফেরিওয়ালা থেকে বড়াে আড়তদার পর্যন্ত সকলকে তলব করলেন—কেন সবরকম খাদ্যবস্তুর এইরকম মূল্যবৃদ্ধি আর অধিকাংশ জিনিসে এইরকম ভেজাল ? এর কারণ কী?
চাই চাই কয়েকজন বলল, হুজুর, ভয়ে বলব, না নির্ভয়ে বলব?
রাজা বললেন, ‘ নির্ভয়ে বলাে।
তখন তারা বললেন, হুজুর, শাক থেকে সােনা—সর্বশ্রেণির বিক্রেতাকেই, শালাবাবু মহাশয়ের সরবত খাবার জন্য প্রত্যহ বেশ কিছু নজর দিতে হয়। সুতরাং জিনিসপত্রের দাম না বাড়ালে আর ভেজাল না দিলে, এ অবস্থায় কারও কারবারই চলবে না।
রাজা বললেন, ‘ঘুস দাও কেন?
‘হুজুর না দিলে রক্ষে আছে? গােড়ার দিকে দু-একজন দিতে রাজি হয়নি। তাদের মালপত্র শালাবাবু মশাই পাইক দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে নদীস্রোতে ফেলে দেওয়ালেন।
‘আচ্ছা, তােমরা যাও। কাল থেকে আগের দামে বেচা-কেনা করাে। সবাই চলে গেল। সন্ধ্যার পর রাজা ঝলমল সিংকে ডাকিয়ে বললেন, ‘কাল থেকে তােমাকে আর বাজার তদারকি করতে হবে না।
‘তাহলে কী করব।”
‘উপস্থিত ঘরে খিল লাগিয়ে আরামে ঘুমােও গে যাও।
কয়েকদিন পরে আবার রানির তাগাদা, হা গা, ওকে বসিয়ে রাখলে আবার ও যে অকর্মণ্য হয়ে খারাপ হয়ে যাবে।
রাজা বললেন, ‘খারাপ যাতে না হয় তার ব্যবস্থা করছি।
তারপর ঝলমলকে ডেকে রাজা বললেন, কাল থেকে তােমায় একটা নতুন কাজ দিচ্ছি। আমার রাজ্যের মধ্যে প্রজাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর নিতে হবে, কারও কোনাে দুঃখ আছে কি না, আর থাকে যদি, সেটা কী দুঃখ।
রােজই কিছু কিছু বাড়ি ঘুরে এর সন্ধান নেবে—আর কাগজে তাদের নাম-ধাম লিখে রিপাের্ট দেবে।
সুতরাং পরদিন থেকে, ঝলমল সিং নতুন উৎসাহে প্রজাদের দুঃখের সন্ধানে বেরুলেন। বাড়ি বাড়ি তার পাহারা পড়ে গেল। সকাল নেই, দুপুর নেই, সন্ধ্যা নেই, রাত নেই—ঝলমলের দুঃখের সন্ধানের ঠেলায় সকলে তটস্থ, ফ্যাসাদগ্রস্ত, সন্ত্রস্ত। বেশ সব সুখে, আনন্দে, আরামে ছিল, এ কী হাঙ্গামা শুরু হল!
গেরস্ত বলছে, আমার কোনাে দুঃখু নেই’-ঝলমল সে কথায় কান দেন না,
বললেন, ‘নেই মানে? ভালাে করে খুঁজে দেখাে, হয়তাে থাকতে পারে। অবশেষে ঝলমলকে কিছু হাতে গুঁজে দিয়ে তবে এই দুঃখের ঝামেলা থেকে মুক্তি।
দুঃখশূন্য প্রজাদের এই দুঃখের কাহিনি আর হয়রানি রাজার কানে গেল। রাজা ঝলমলকে আবার তলব করলেন এবং দুঃখ খোঁজার কাজ বন্ধ করে দিয়ে বললেন, ‘কাল সকালেই তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে, তােমার কোনাে নতুন কাজের ব্যবস্থা করব।
সন্ধ্যার পর, মন্ত্রী কূটবুদ্ধিশ্রীর সঙ্গে রাজা এবিষয়ে বহুক্ষণ ধরে শলাপরামর্শ করলেন। কূটবুদ্ধিশ্রী বললেন, ‘মহারাজ! শালাবাবু মশায় ঘুস নিয়ে নিয়ে ঘুসঘুসে অভ্যাসরােগে আক্রান্ত হয়েচেন।
ঘুসঘুসে জ্বর হলে, ঘলঘলে পাতার রসের নস্য নিলে সেরে যেত। কিন্তু ওঁর অন্য ব্যবস্থা করা দরকার।
অতঃপর মন্ত্রী মহারাজকে যে পরামর্শ দিয়ে গেলেন, তদনুযায়ী পরদিন সকালে শালাবাবুমশাই রাজার কাছে এলে, রাজা বললেন, “দেখাে ঝলমল, একটা উঁচুদরের কাজ তােমায় দিচ্ছি, তুমি ছাড়া এ কাজ আর কেউ পারবে না, কাজ একেবারে সরল — তরল —জল।
ঝলমল সিং কিছু বুঝতে না পেরে, চুপ করে রাজার মুখের দিকে চেয়ে বসে রইলেন।
রাজা বললেন, ‘কাল থেকে তােমাকে ঢেউ গুনতে হবে। নদীতীরে আমাদের যে ঘাট আর চাঁদনি আছে, ওইখানে তুমি কাগজ-কলম নিয়ে চৌকি পেতে বসবে, আর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীর জলে যত ঢেউ উঠবে তার হিসেব লিখবে।
ঝলমল সিং কাজে লেগে গেলেন, অর্থাৎ নদীর ঢেউ গুনতে লাগলেন। রােজ সকালেই বেরিয়ে যান, আর সন্ধ্যায় ফিরে, রাজাকে তার ঢেউয়ের হিসেব শুনিয়ে যান—আজ দু-হাজার, আজ পাঁচ হাজার, আজ সাড়ে-নশাে, আজ আট হাজার ইত্যাদি।
এবার দিন বেশ যেতে লাগল, কোনাে হাঙ্গামা নেই, কারও কোনাে নালিশ আপত্তি নেই। মহারাজও সুখে রাজকার্য করতে লাগলেন। ঝলমল সিংহও নির্বিবাদে ঢেউ গুনে যেতে লাগলেন।
সহসা এ-রাজ্যের, ও-রাজ্যের সে-রাজ্যের বড়াে বড়াে কারবারি মহাজনরা রাজার কাছে তাদের নালিশ জানাতে এল—শালা বাবুমশায়ের জন্যে আমাদের কাজকারবারে ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে, ব্যাবসা-বাণিজ্যে আর লাভ করতে পারা যাচ্ছে না।
সকলে জোড় হাতে রাজার কাছে প্রার্থনা জানাল—“মহারাজ আমাদের চিরকালের ব্যাবসা-বাণিজ্য রক্ষা করুন, নচেৎ আমরা দুঃখদুর্দশায় পড়ে মারা যাব।’
ব্যাপারটা কী?
তখন তাদের মধ্যে দু-একজন এগিয়ে এসে বলল, “মহারাজ ভয়ে বলব, না নির্ভয়ে বলব?
রাজা বললেন, ‘ নির্ভয়ে বলাে।
তারা বলতে লাগল, হুজুর বাণিজ্য-ব্যাবসা করাই আমাদের সাতপুরুষের পেশা। এই নদী দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশে আমরা মালপত্র নিয়ে যাই, আর আসি। চাদনির সামনে আসতেই, হঠাৎ শালাবাবু মশায় হুকুম করলেন, ‘নৌকো থামাও। আর এগুবে না—আমার ঢেউ যদি ভেঙে যায়, তাহলে আর গােনা যাবে না।
তার হুকুম মতাে দু-দিকের নৌকোই থামাতে হল, কারও আর যাবার উপায় রইল না। আমাদের কাজ হয়তাে খুবই জরুরি, কিন্তু সে স্থলে হয়ুতাে দু-ঘন্টা আড়াই-ঘন্টা ধরে সব নৌকোকে এইভাবে আটক থেকে, প্রচুর ক্ষতি সহ্য করতে হল।
সেজন্যে উপায়ান্তর না দেখে, প্রত্যহই ওঁনাকে আমাদের ঘুস দিয়ে, তবে নৌকো ছাড়াতে হয়। রােজ আমরা এইরকম দিতে থাকলে লাভ করব কী করে, হুজুর।
রাজা জিজ্ঞেস করলেন, ‘রােজ কত টাকা করে তােমরা এই রকম ঘুস দাও?’
তা হুজুর, প্রায় একশাে তঙ্কা হবে। পরের দিন থেকে শালাবাবু মশায়ের ঢেউ গােনার কাজ বন্ধ হয়ে গেল।
মন্ত্রী কূটবুদ্ধিশ্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে, রাজা ঝলমল সিংকে ডেকে বললেন, কাল পশ্চিম সীমানার মাঠে, তালগাছ সমান উঁচু একটা বাঁশের খুঁটি পুঁতে দেওয়া হবে।
তুমি সেইখানে একটা তাঁবু খাটিয়ে, চৌকি পেতে বসে কাগজ-কলম নিয়ে হিসেব রাখবে—প্রত্যহ কত পাখি এসে সেই খোঁটার মাথায় বসে।
কোনটা কী রঙের আর কোনটা দেখতে বড়াে, কোনটা মাঝারি আর কোনটা ছােটো। আর কে কেমন গান গায়, কেমন শিস দেয় এসবও লিখবে। কাল থেকেই এ কাজে লেগে যাও। বুঝলে?
বুঝবে কে? ঝলমল তখন টলটলায়মান। তিনি মাথা হেঁট করে নীরব দাঁড়িয়ে রইলেন।
2 thoughts on “ঝলমল সিং – এর কাহিনী।”