বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সব দিক থেকেই, সব অর্থেই তিনি হলেন বিশ্বকবি। শুধু কবি হিসাবে তিনি খ্যাতি লাভ করেননি। সাহিত্য-এ প্রচুর খ্যাতি লাভ করেন। সাহিত্যের এমন কোনাে শাখা নেই।
যেখানে তাঁর গর্বিত পদচিহ্ন আঁকা হয়নি। শুধু তাই নয়, একাধারে তিনি ছিলেন কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছােটো গল্পকার, প্রবন্ধকার ইত্যাদি। তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তাই নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবি বলেছেন আমি পৃথিবীর কবি যেথা তার যত ওঠে ধ্বনি আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনই।
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৮ মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়। উত্তর কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে তিনি জন্মেছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ হলেন তাঁর পিতা এবং মা হলেন সারদা দেবী।
ঠাকুরবাড়ি প্রত্যেক দিন বাংলার সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। জোড়াসাঁকোর ওই বিশাল অট্টালিকায় সন্ধ্যাসমাপমে বাংলা শিল্প সাহিত্যের কৃতী ব্যক্তিরা আসতেন।
ঠাকুরবাড়ির প্রতিটি মানুষ ছিলেন সংস্কৃতি অনুরাগী। তাই ছােটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করেছিল এক সাংস্কৃতিক অভিচেতনা।
তিনি বিখ্যাত মনীষিদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোেগ অর্জন করেছিলেন ছােটবেলা থেকেই। এইভাবেই তাঁর মনে প্রাণে সাহিত্যিক সত্তা গড়ে উঠেছিল।
পিতার সান্নিধ্য হল রবীন্দ্রনাথের আরাে একটি সৌভাগ্য। যদিও একেবারে ছােটো বেলায় পিতাকে তিনি সেভাবে কাছে পাননি। কিন্তু পরবর্তীকালে হিমালয় ভ্রমণ করেন রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে। তাঁর মনকে প্রাজ্ঞ করে তােলে এই ভ্রমণ।
রবীন্দ্রনাথের পিতামহ ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি ছিলেন এক কৃতবিদ্য ব্যবসায়ী। তিনি তাঁর বাড়ি অর্থাৎ ঠাকুরবাড়ির মানমর্যাদা অনেক উঁচুতে নিয়ে যান।
দ্বারকানাথ ছিলেন রাজা রামমােহন রায়ের সমসাময়িক এবং বন্ধু। তাঁরই বড় ছেলে হলেন দেবেন্দ্রনাথ। দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র হলেন সত্যেন্দ্রনাথ। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম সিভিলিয়ান বা আই. সি. এস।
রবীন্দ্রনাথের শিশুকাল অতিবাহিত হয় এই জাতীয় পরিমণ্ডলের মধ্যে। মাধব পণ্ডিতের কাছে তাঁর লেখাপড়া চলত। রবীন্দ্রনাথ যখন একটু বড়াে হলেন তখন তিনি এলেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে।
রবীন্দ্রনাথ এখানকার পরিবেশের সঙ্গে থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেন। তিনি হলেন মুক্ত মনের মানুষ। তিনি শিক্ষা গ্রহণ করতেন প্রকৃতির খেয়ালিখেলাঘরে থেকে। তাঁকে কি আমরা ধরাবাঁধা পাঠক্রমের মধ্যে বন্দি করতে পারি না?
রবীন্দ্রনাথ ওরিয়েন্টাল সেমিনারি থেকে এলেন নর্মাল স্কুলে। নর্মাল স্কুল থেকে আবার তাঁকে বেঙ্গল অ্যাকাডেমি নামে একটি ফিরিঙ্গি স্কুলে আনা হল।
রবীন্দ্রনাথের যখন এগারাে বছর বয়স তখন তাঁর পৈতে হয়। পৈতে অর্থাৎ উপনয়ন। এই উপনয়নের পর তিনি হিমালয় অঞ্চলে গেলেন পিতার সঙ্গে। সেখানে চার মাস কাটিয়েছিলেন। তখন পিতা বিভিন্ন বিষয়ে আলােচনা করতেন পুত্রের সঙ্গে।
হিমালয় অঞ্চল থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ বেঙ্গল অ্যাকাডেমি যাতায়াত শুরু করেন। কিন্তু বেঙ্গল অ্যাকাডেমির পরিবেশও তাঁকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করতে পারেনি।
তিনি মাত্র এগারাে বছর বয়সে কলম হাতে লিখলেন এক অসাধারণ কবিতা ‘অভিলাষ। অভিলাষ’-এর মাধ্যমে সূত্রপাত হল পরবর্তীকালে যিনি সারা পৃথিবীর মানুষকে এক করে দেবেন কবিতার মাধ্যমে।
স্কুল থেকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আসা হল, রবীন্দ্র প্রতিভাকে শুধু স্কুলের গণ্ডিতে বন্দী রেখে লাভ নেই, সেটি অভিভাবকেরা বুঝতে পেরেছিলেন।
তাই বাড়িতেই পড়াশুনার ব্যবস্থা কার হল। চোদ্দ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ভর্তি হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। সদ্য এই সময় কিশাের রবীন্দ্রনাথের জীবনে ঘটে যায় এক দুঃখজনক ঘটনা। তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়।
সামান্য কয়েকদিন জুরে ভােগার পরেই। এরপর স্কুলে আসা-যাওয়া অনিয়মিত হয়ে ওঠে। ফলে তিনি তিরিশ বছর বয়সে একবার ইউরােপ ঘুরে আসেন।
এবং লিখে ফেললেন এক সুন্দর রােজনামচা ইউরােপ যাত্রীর ডাইরি’। ভাবলে অবাক হতে হয় যে রবীন্দ্রনাথ একজীবনে এত কাজ করে গেছেন। সবসময় সাহিত্যকর্ম ছাড়াও তিনি দেশ এবং দেশের সেবা করেছেন।
কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। তিনি ব্রহ্মচর্য আশ্রম স্থাপন করেছিলেন শান্তিনিকেতনে। ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত হয় নতুন পত্রিকা।
এই পত্রিকা সাধনার জন্য তাঁকে নিয়মিত ভাবে লিখতে হত। তখন উনবিংশ শতাব্দীর শেষ অর্থাৎ মৃত্যু ঘণ্টা বেজে গেছে। সমস্ত জাতি উন্মুক্ত চিত্তে অপেক্ষা করছে নতুন শতাব্দীকে বরণ করার জন্য।
রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন নতুন ভাবধারায় প্রকাশিত হল নতুন শতাব্দীর সূচনায়। তখন তাঁর বয়স চল্লিশ বছর।
তিনি নতুনত্বের সন্ধান যখন পেতেন তখনই আবার তাঁর সমস্ত চেতনা সজাগ হয়ে উঠত—এটিই রবীন্দ্র প্রতিভার একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
এবার উপন্যাসের পথে জয়যাত্রা শুরু হল। লিখলেন ‘চোখের বালি’। এই প্রথম মনােবিশ্লেষণ মূলক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে লেখা হয়। ১৯০২ সালে তাঁর পত্নী মৃণালিনীদেবীর মৃত্যু হয়। মাত্র তিরিশ বছর বয়সে মৃণালিনীদেবীর মৃত্যু হয়।
বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলন হয় ১৯০৫ সালে। তাই ১৯০৫ সালে আমার বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি।
এইসময় তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা রচনা করেন বাংলার মাটি বাংলার জল’। কলকাতায় জাতীয় পরিষদ স্থাপিত হয়, এই শিক্ষা পরিষদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যুক্ত ছিলেন।
কবি ১৯১১ সালে পঞ্চাশ বছর বয়সে পা দেন। তাঁর জন্মােৎসব অত্যন্ত সাধারণভাবে পালিত হয়। তিনি বিলেত যাত্রা করেন ১৯১২ সালের ১২ মে। সঙ্গে ছিল গীতাঞ্জলী’-র ইংরাজি তর্জমা।
কবিতাগুলি পড়ে মুগ্ধ হলেন ইয়েটস প্রমুখ ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট কবিরা। লন্ডনের ইন্ডিয়া সােসাইটি থেকে প্রকাশিত হল ‘গীতাঞ্জলী’র ইংরাজি অনুবাদ Songs Offerings.
দেড়বছর বয়সে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। সবথেকে স্মরণীয় মুহূর্ত তাঁর জীবনে এসে গেল। ভারতবাসীদের কাছে একটি মনে রাখার মতাে তারিখ হল ১৯১৩ সালের ১৫ নভেম্বর।
সন্ধ্যায় ওই দিন বিলেত থেকে তারবার্তা এল সাহিত্যের জন্য নােবেল পুরস্কার পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এশিয়াবাসীদের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। যাকে এই দুর্লভ সম্মানে সম্মানিত করা হল।
১৯১৪ সালে রণ দামামা বেজে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। এই যুদ্ধের খবর পেয়ে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। “বিশ্বের পাপের যে মূর্তি আর রক্তবর্ণ দেখা দিয়েছে, সেই বিশ্বপাপকে দূর করাে”—তিনি লিখেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথকে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৫ সালে স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করে। চারবছর বাদে এই উপাধি ত্যাগ করেছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে।
তিনি একটি খােলা চিঠি লিখেছিলেন বড়ােলাট লর্ড চেমসফোর্ডকে। আমরা বুঝতে পারি কবি স্বদেশ চিন্তায় কতখানি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এই অতুলনীয় ভাষায় লেখা চিঠিখানি পড়লে।
কবিকে বারংবার বিদেশে যেতে হয় শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের অর্থ সংগ্রহের জন্য। তিনি আমেরিকা ইউরােপ এবং জাপানে গিয়েছিলেন। যখন ভারতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয় তখন কবি বিদেশে ছিলেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজীর মহত্ত্ব স্বীকার করে তাঁকে অভিহিত করেছিলেন মহাত্মা নামে।
কবি সত্তরের কোটায় উপনীত হলেন। রবীন্দ্রজয়ন্তী মহা সমারােহে পালন করলেন গুণমুগ্ধ দেশবাসী। সেইদিন ভাষণ প্রসঙ্গে কবি বলেছিলেন—“একটি মাত্র পরিচয় আমার আছে, সে আর কিছু নয়, আমি কবি মাত্র।”
এই উপলক্ষে জয়ন্তী উৎসব সমিতির তরফ থেকে The Golden Book of Tagore নামে একটি পুস্তক তুলে দেওয়া হয় কবির হাতে। এই গ্রন্থ লিখেছিলেন দেশ বিদেশের অনেক বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক এবং বিখ্যাত প্রবন্ধকাররা।
১৯৩৭ সালে তাঁকে ডি. লিট উপাধিতে ভূষিত করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। এই সংবাদ শুনে দুঃখ পেয়েছিলেন প্রবীণ কবি।
কবি ১৯৪০ সালের ৭ জুন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি পান। এটি তাঁর শেষ সম্মানলাভ। তারপর এল নববর্ষ। কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হল “ওই মহামানব আসে” কবিতার মাধ্যমে।
১৯৪১ সালের ৭ আগষ্ট ছিল রাখী পূর্ণিমার দিন। ওই দিন রবি-সূর্য অস্তমিত হয় জোড়া সাঁকোর পৈতৃক ভবন থেকে।
আরও পড়ুন –
শিবনাথ শাস্ত্রী – সাহিত্য জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, পুরোধা পুরুষ।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য | কিশোর কবি | বিশিষ্ট সাহিত্যিক | Sukanta Bhattacharya
3 thoughts on “বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – কবিগুরু ,নোবেলজয়ী, গীতাঞ্জলির রচয়িতা, বাঙালির গর্ব, জাতীয় সংগীতের রচয়িতা।”