রাজা রামমােহন রায়
সর্বার্থে তাঁকে আমরা এক আধুনিক মানুষ বলতে পারি। তিনিই প্রথম ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়ে ছিলেন। তিনি হলেন রাজা রামমােহন রায়।
রামমােহন রায়ের জন্ম হয় ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মে। তিনি জন্মেছিলেন হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে। যখন তাঁর জন্ম হয়, তখন এদেশে সবেমাত্র ইংরেজ শাসন কায়েম হয়েছে।
তখন সমাজে ছিল নানা ধরণের অত্যাচার। ছিল কুসংস্কারের অন্ধকার।
রামমােহন রায়ের বাবার নাম রামকান্ত রায়। মায়ের নাম তারিণীদেবী। রামকান্ত রায়ের পূর্বপুরুষের পদবি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বাদশাহ ফারুক শিয়রের আমলে বাংলার সুবেদারের অধীনে আমিনের কাজ করতেন। এই সূত্রে তাঁরা রায়’ উপাধি পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রায় উপাধিটির ব্যবহার প্রচলিত হয়।
রামমােহনের ছেলেবেলার অনেক কথা আমাদের জানা আছে। রামমােহন ছােটো থেকেই ছিলেন একরােখা স্বভাবের শিশু। কালী মন্দিরের ভেতর দেবীর সামনে পূজার ফুল আছে, আছে পূজার নৈবেদ্য।
একটুবাদে পুজো শুরু হবে। পুরােহিত চান করতে গেছেন। ফিরে এসে পুজো শুরু করবেন। তখন রামমােহনের বয়স তিন-চার বছর। তিনি ওই ঠাকুর ঘরে ঢুকলেন। কালী ঠাকুরের মুর্তির দিকে তাকালেন।
তারপর পুজোর ফুলগুলির দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ পর পুজোর ফুল নিজের হাতে তুলে নিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে দিলেন। বেলপাতা মাটিতে ছিটিয়ে দিলেন।
এই সময় রামমােহনের মা সেখানে এসে এসব কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেলেন। একটু পরে স্নান সেরে এলেন পুরােহিত।
পুরােহিত আর কেউ নন, রামমােহনের মাতামহ। তিনি এক পরমসাধক। দৌহিত্রের এই অপকীর্তি দেখে রেগে আগুন হয়ে গেলেন। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন—“তাের এই ছেলে বিধর্মী হবে।”
– একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে রামমােহনের মা কাঁদতে শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে মাতামহ বলেছিলেন—“যা যা বলেছি, অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাবে। তবে তাের ছেলে জগদ্বিখ্যাত পণ্ডিত হবে।”
ভাবতে অবাক লাগে ওই অশান্ত রামমােহনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মাতামহের আশীর্বাদ এবং অভিশাপ দুই-ই একই সঙ্গে ফলে গিয়েছিল।
বালক রামমােহনকে প্রথমে পাঠশালায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। তখনকার দিনে পড়াশােনার তিনটি মাধ্যম ছিল—এক পুরুতমশায়ের পাঠশালা, দুই, ভট্টাচার্যের চতুষ্পঠী এবং তিন মৌলবীদের মক্তব।
পড়াশােনায় রামমােহনের আগ্রহ দেখে মাস্টারমশাই একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। অল্প দিনেই রামমােহন পাঠশালার পড়া শেষ করলেন। এবার এলেন চতুষ্পঠীতে। সেখানকার পড়াশােনাও শেষ করতে রামমােহনের বেশি সময় লাগেনি।
পাড়ার লােকেদের কাছে তাঁর এই আশ্চর্য প্রতিভার খবর পৌঁছে গেল। গ্রামের মাতব্বররা বলাবলি করলেন—বড়াে হয়ে এই ছেলে একদিন বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত হবে।
তখন দেশে ইংরেজ শাসন চালু হয়েছে, কিন্তু মুসলমানী আমলের আইনকানুন তখনও বজায় আছে। আদালত এবং সরকারি কাজকর্মে ফারসি এবং আরবি ভাষার প্রচলন ছিল।
ভালাে চাকরি পেতে হলে এই দুটি ভাষা জানা একান্ত দরকার। এই দুটি ভাষা না জানলে কাউকে বিদ্বান হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হত না।
রামকান্ত ঠিক করলেন তাঁর ছেলেকে এই দুটি ভাষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। এইজন্য তিনি বাড়িতে এক মৌলবী রাখলেন। আট বছর বয়সের মধ্যেই রামমােহন আরবি ভাষা শিখে ফেললেন।
তখনকার দিনে ফারসি ভাষার ভালাে কেন্দ্র বাংলাদেশে ছিল না। ফারসি এবং আরবি ভাষার কেন্দ্র ছিল পাটনা।
রামকান্ত রামমােহনকে পাটনায় পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে গিয়ে রামমােহন এই দুটি ভাষার সঙ্গে পরিচিত হলেন। এর পাশাপাশি ইসলামিক ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতে থাকলেন।
ইসলাম ধর্ম মূর্তি পুজোর বিরােধী। তারা নিরাকার ঈশ্বর বা আল্লাহর উপাসক। ইসলামিক ধর্মপুস্তক পাঠ করে রামমােহন ভাবলেন, মুর্তি পুজো করে কী লাভ? তিনিও মূর্তি পুজোর বিরােধী হয়ে উঠলেন।
পাটনার পড়াশােনা শেষ করে কলকাতায় ফিরে এলেন সদ্য কিশাের রামমােহন। ইতিমধ্যে তাঁর ব্যক্তিত্বে যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটে গেছে।
তাঁর মুখ থেকে তখন শুধুই শেখ সাদের কবিতা শােনা যায়। শােনা যায় আরবি আর ফারসি বুলি। ঠাকুর মন্দিরের কাছে কখনাে যান না।
ছেলের চরিত্রের এই পরিবর্তন দেখে মা তারিণীদেবী খুবই দুঃখ পেলেন। মনে পড়ে গেল বাবার অভিশাপের কথা। স্বামীকে সবকিছু জানালেন।
রামকান্ত ভাবলেন সংস্কৃত ভাষা এবং হিন্দুদের প্রাচীন শাস্ত্র পাঠ করলে নিশ্চয় ছেলের মনােভাবের পরিবর্তন হবে। তাই রামমােহনকে কাশীতে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
মেধাবী রামমােহন কাশীতে গিয়ে আচার নিষ্ঠ ব্রাহ্মণদের সংস্পর্শে এলেন। কিছুদিনের মধ্যেই সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করে ফেললেন। পড়লেন ভাষ্যসমেত বেদ ও উপনিষদ।
তিনি দেখলেন উপনিষদেও এক ও নিরাকার ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে। তার মানে? ছােটো বেলা থেকে আমরা যে দেবদেবীর কথা বলে আসছি তা কি একেবারে ভুল।
তখন রামমােহনের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিল। এক এবং নিরাকার ঈশ্বরকেই পুজো করতে হবে—একথাই ভাবলেন তিনি।
কাশীর পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্ক এবং আলােচনার প্রবৃত্ত হলেন। কেউই তাঁর মতামত খণ্ডন করতে পারলেন না। তর্কে হেরে গিয়ে কাশীর পণ্ডিতরা তাঁকে নাস্তিক অপবাদ দিলেন।
কাশীর পড়া শেষ করে রামমােহন কলকাতায় ফিরে এলেন। ভাবলেন, ছেলে যখন এত পণ্ডিত হয়ে ফিরে এসেছে, তখন আর কোনাে ভাবনা নেই, ছেলে এবার নিশ্চয় নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের মতাে আচরণ করবে।
তারিণীদেবী ছেলেকে বললেন—রাম, ঠাকুর ঘরে গিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করে আয়।
রামমােহন বললেন— না না, এইসব পুতুল ঠাকুরের কাছে আমি মাথা নত করব কেন?
মা একথা শুনে শিউরে উঠে বলেছিলেন—ছিঃ ছিঃ, সংস্কৃত পণ্ডিত হয়ে তাের এমন দুর্মতি হল ?
রামমােহন বললেন—মা, সংস্কৃত পড়লেই কি ঠাকুরকে মানতে হবে নাকি? তখন তার বয়স মাত্র যােলাে বছর, মূর্তি পূজার বিরুদ্ধাচরণ করে একটি বই লিখে ফেললেন।
ছেলের এই কীর্তি দেখে বাবা খুব রেগে গেলেন। তিনি ছেলেকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন।
কিশাের রামমােহনের জীবনে এই ঘটনার সুদূর প্রসারী ফল হয়েছিল। নিঃসম্বল নিঃসঙ্গ রামমােহন হেঁটে হেঁটে নানা দেশ এবং তীর্থ পর্যটন করলেন।
তিনি এসে পৌছালেন তিব্বতে। তিব্বত হল এক নিষিদ্ধ দেশ। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, রামমােহন দেখলেন বৌদ্ধরা দেবদেবীর পূজা করে , তবে তারা লামা বার ধর্মগুরুকে দেবতা জ্ঞানে ভক্তি করে।
আজও মানুষদের ওপর লামারা অত্যাচার চালান। কিন্তু কেউ তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না।
এসব দেখে রামমােহন মনে মনে খুব আঘাত পেলেন। তিনি সকলকে বােঝাতে চেষ্টা করলেন যে, এইভাবে লামাকে দেবতা হিসাবে পূজা করা উচিত নয়। এর ফল হল বিপরীত।
লামারা রামমােহনের আচরণে অত্যন্ত রেগে গেলেন। তাঁরা তিব্বতিদের লেলিয়ে দিলেন রামমােহনকে হত্যা করার জন্য।
এইসময় কয়েকজন দয়াবতী তরুণী রামমােহনকে লুকিয়ে রেখে তাঁকে পালাবার সুযােগ করে দিয়েছিলেন।
এই ঘটনা রামমােহনের জীবনে গভীর রেখাপাত করেছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মেয়েরা কত দয়াময়ী, তারা না থাকলে পুরুষরা জীবনে চলতে পারবে না।
১৮৩০ সালের ১৯ নভেম্বর মাসে দিল্লির, বাদশা দ্বিতীয় আকবর রামমােহনকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি রামমােহনকে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন। বিলেতে রামমােহন উইনেটিরিয়ান সমিতির সংবর্ধনা লাভ করেন।
রামমােহনের জীবনে সব থেকে বড়াে কৃতিত্ব হল সতীদাহ প্রথা রদ করা। তখনকার দিনে বিধবা হিন্দু রমণীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হত। একে বলে সতীদাহ।
এই কুপ্রথা শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হল। বহুবিবাহ সম্পর্কেও রামমােহন সােচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
তাঁর হাত ধরেই বাংলা গদ্য সাহিত্যের আবির্ভাব। তখনকার দিনে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত, আরবি প্রভৃতি শব্দের চল ছিল। সেই ভাষা পড়ে আমরা কিছুই বুঝতে পারতাম না।
রামমােহন প্রথম সেই ভাষাকে বােধগম্য করে তুললেন।
১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইংল্যাণ্ডের ব্রিস্টল শহরে রাজা রামমােহনের মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন –
রাহুল সংকৃত্যায়ন – বহুভাষাবিদ, পঙ্গু ও ভন্ড সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক অনন্য লেখক। Rahul Sankrityan
সরােজিনী নাইডু | নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া |Nightingale of India| Sarojini Naidu
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ – আইনবিশারদ, ব্যারিস্টার, দেশপ্রেমিক। Chittaranjan Das | Indian lawyer
2 thoughts on “রাজা রামমােহন রায় – আধুনিক ভারতের অন্যতম কারিগর, বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক। Ram Mohan Roy”