সরােজিনী নাইডু | নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া |Nightingale of India| Sarojini Naidu

সরােজিনী নাইডু

সুন্দর কবিতা লিখতেন বলে তাঁকে নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া বলা হয়। তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী ছিলেন। তিনি হলেন ভারতের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল স্বাধীনতা লাভের পর।

যার সম্পর্কে এইসব কথা বলা হচ্ছে তাঁর নাম সরােজিনী নাইডু। জন্মসূত্রে একসময় ভারত জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন বাঙালি এই মেয়েটি। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম হয়। তিনি জন্মেছিলেন দাক্ষিণাত্যের হায়দ্রাবাদ শহরে। তাঁর বাবার নাম ডাঃ অঘাের নাথ। তাঁর পৈত্রিক আবাস ছিল পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার ব্রাহ্মণ গাঁ-তে।

প্রাচীন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতবংশের সন্তান ছিলেন অঘােরনাথ। তাঁর পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত পাণ্ডিত্যের জন্য সুখ্যাতি ছিল। বিলেতে গিয়েছিলেন গিলক্রাইস্ট বৃত্তি নিয়ে। এডিনবরা থেকে ডক্টর অব সাইন্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

প্রসঙ্গত বলা যায়, প্রথম ভারতীয় হলেন অঘােরনাথই যিনি এই ডিগ্রি লাভ করেন। হায়দ্রাবাদে নিজামের উৎসাহে ভারতে এসে হায়দ্রাবাদ কলেজ স্থাপন করেন। তাঁকে এই কলেজের পরিচালকের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। অঘােরনাথ চট্টোপাধ্যায় হায়দ্রাবাদে সাধারণ মানুষের কাছে শিক্ষাগুরু নামে বিখ্যাত। অবসর সময়ে কবিতা লিখতেন। একদিকে যেমন প্রকৃতি অন্বেষণার ছায়া থাকত তার কবিতার মধ্যে তেমনি অন্যদিকে আলােকপাতের চেষ্টা করা হত মানবজীবনের দৈনন্দিন ঘটনা প্রবাহের উপর। অঘােরনাথ কবি হিসাবে যথেষ্ট খ্যাতি ও সম্মানলাভ করেছিলেন।

সরােজিনীর মায়ের নাম বরােদা সুন্দরী। সুগায়িকা তিনি ছিলেন। তিনিও বাংলাভাষায় ছন্দবদ্ধ কবিতা লিখতেন। সরােজিনী অনেকগুলি গুণ অর্জন করেছিলেন এই ধরণের মা-বাবার কাছ থেকে।

যে হায়দ্রাবাদ শহরে সরােজিনীর জন্ম হয় সেখানে হিন্দু এবং মুসলিম সংস্কৃতির সহাবস্থান। যেসব বৈশিষ্ট্য আছে এই দুটি সংস্কৃতির মধ্যে, তা প্রত্যক্ষ করেন বালিকা সরােজিনী। তাই বােধ হয় তিনি প্রবক্তা হয়ে উঠেছিলেন হিন্দুমুসলমান সম্প্রীতি আন্দোলনের।

বাঙালি পরিবার হলে কী হবে? ইংরাজি ভাষার ঢল ছিল অঘােরনাথের বাড়িতে। এমনকি তাঁরা ইংরাজিতে কথাবার্তা বলতেন পরস্পরের মধ্যে। অঘােরনাথ অভ্যস্ত ছিলেন ইংরেজদের মতাে আদবকায়দায়।

এই পরিবেশে খুব একটা মেলে ধরতে পারতেন না নিজেকে বরােদাসুন্দরী। তাই অন্তঃপুরে ছিল তাঁর স্থান। সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে পরিচালনা করতেন। এমনকি বাড়িতে কোনাে অতিথি এলেও তাঁদের পরিচর্যা করতে দেখা যেত।

সরােজিনীর বয়স তখন মাত্র ন’বছর। চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে দু’জন অতিথি এলেন। অতিথিদের সাথে কথা বলতে হবে সরােজিনীকে বলা হল। সরােজিনী কিছু ভুল ইংরাজি বলে ফেলেছিলেন অতিথি আপ্যায়ন করতে গিয়ে। সেই ভুল ইংরাজি শুনে খুবই রেগে যান অঘােরনাথ। সরােজিনীকে তিনি আড়ালে ডেকে নিয়ে যান এবং যথেষ্ট তিরস্কার করেন। তিনি বলেন শুদ্ধভাবে বলতে হবে যেকোনাে ভাষা বলতে গেলে। না হলে সে ভাষায় কথা বলবে না।

সরােজিনীকে অত্যন্ত আহত করে বাবার এই কটি কথা। তিনি চেষ্টা করলেন যাতে ভালাে ইংরেজি বলতে পারেন। এর ফলে সরােজিনী ইংরাজি ভাষায় সুপণ্ডিত হয়ে উঠলেন। ভবিষ্যতে বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিলেন এই ভাষায় কবিতা লিখে।

তখন এগারাে বছর বয়স মাত্র সরােজিনীর। মেয়ের দিকে বাবার নজর। নিয়ম করে পড়তে বসতে হচ্ছে দু’বেলা।

মেয়েকে একদিন বীজগণিত কষতে দিয়েছেন বাবা। সরােজিনী অঙ্কটি মেলাতে পারছেন না, বারবার চেষ্টা করেও।

খাতা বন্ধ করে দিলেন বিরক্ত হয়ে। খােলা জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাকালেন বাইরের আকাশের দিকে। মেঘ আর রােদুরের খেলা। দূরের গাছপালা মাঠ সবুজ জাজিমের মতাে। পাখিদের কলকাকলি—প্রকৃতির একটুকরাে জল ছবি। সরােজিনী কেমন হয়ে গেলেন এক মুহূর্তের জন্য। তিনি দেখতে দেখতে কোথায় হারিয়ে গেলেন। তাঁর আর অঙ্কের কথা মনেই রইল না। কিছুক্ষণ পর অঙ্কের খাতা খুলে বসলেন। বেচারি সরােজিনীর মনে পড়ে গেল বাবার গম্ভীর মুখখানা। কিন্তু তিনি অঙ্ক না কষে একটি কবিতা লিখে ফেললেন।

সন্ধ্যের পর খাতা পরীক্ষা করতে এলেন সরােজিনীর বাবা। খাতায় অঙ্কটি কাটাকুটি করা হয়েছে। পরের পাতায় লেখা হয়েছে একটি ইংরাজি কবিতা। অঘােরনাথ কৌতূহলী হয়ে কবিতাটি পড়লেন। অসাধারণ বর্ণনা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের।

মেয়েকে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন—“এই কবিতাটি কার লেখা? অঙ্ক কষতে

পেরে তুমি কার লেখা কবিতা খাতায় তুলেছ? কেনই বা তুলেছ?”

সরােজিনী মাথা নীচু করে জবাব দিলেন—“না বাবা, আমি নিজেই এই কবিতাটি লিখেছি। এটা অন্য কারাে কবিতা নয়।”

অবাক হয়ে গেলেন অঘােরনাথ। এমন সুন্দর ইংরাজি লিখতে পারে এগারাে বছরের ছােট্ট মেয়ে? তিনি আশীর্বাদ করলেন সরােজিনীকে। বললেন—“লেখ, কবিতা লেখ তুমি।”

সেই থেকে সরােজিনীর কবিতা লেখা শুরু হল। তাঁর কাব্যচর্চা চলল পড়াশােনার পাশাপাশি।

সরােজিনীর যখন বারাে বছর বয়স, তখন তিনি উত্তীর্ণ হলেন এন্ট্রান্স পরীক্ষায়। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা শিক্ষা জগতে।

কিন্তু তাঁর শরীর খারাপ হয়ে গেল, সারাদিন পড়াশােনার মধ্যে ডুবে থাকতে হত বলে। অঘােরনাথ চিন্তিত হয়ে পরামর্শ নিলেন ডাক্তারের।

ডাক্তার ভালােভাবে পরীক্ষা করে বললেন—কিছুদিন এখন বিশ্রামে রাখতে হবে মেয়েকে।

ডাক্তারের পরামর্শ মতাে মেয়েকে পড়াশােনা করতে বারণ করলেন অঘােরনাথ। বিদেশি নার্স ঘরে রাখা হল। সময় মতাে সেই নার্স ওষুধপত্র দেন। কিন্তু সরােজিনী মানতে চান না এইসব নিয়ম।

দু-একদিন চুপচাপ শুয়ে থাকলেন পড়াশােনা বন্ধ করে। বই পড়লেন না, তবে লিখতে বসলেন কবিতা। দু’দিনে তেরােশাে লাইনের এক কাব্য লিখে শেষ করলেন। আর লিখলেন দু’হাজার লাইনের এক নাটিকা।

অঘােরনাথ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন মেয়ের এমন অভাবিত কীর্তি দেখে। হায়দ্রাবাদের নিজামকে নাটিকাটি ছাপিয়ে উপহার দিলেন।

সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন নিজাম। অবাক হয়ে গেলেন কিশােরী বালিকার এই অসামান্য প্রতিভার পরিচয় পেয়ে। তিনি একটা পুরস্কার দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন সরােজিনীকে।

বার্ষিক তিনশাে পাউন্ড বৃত্তি ধার্য করেছিলেন সরােজিনীর জন্য। সরােজিনী যােলাে বছর বয়সে সেই বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে গেলেন। শিক্ষালাভ করলেন কিংস কলেজ আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সরােজিনী পড়াশােনায় খুবই ভালাে ছাত্রী ছিলেন। ইংরাজি এবং বাংলা ছাড়াও উর্দু ও ফার্সি ভাষাতে জ্ঞানার্জন করেছিলেন।

অল্প বয়েসেই তাঁর মনে জন্ম হয়েছিল পরিণতি বােধের। বিদেশে গিয়ে শিক্ষা লাভ করা তাঁর ইচ্ছা ছিল। শিক্ষার আলােকে নিজেকে উদ্ভাসিত করবেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর এই ইচ্ছে সফল হয়েছিল।

১৮৯৮ সালে বাঙালি কন্যা সরােজিনী বিয়ে করলেন হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত চিকিৎসক ডঃ মতিলাল নেহেরুকে। তখন থেকেই তিনি পরিচিত হলেন।

পরবর্তীকালে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে সরােজিনী নিজেকে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত করেছিলেন। তাঁকে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে। তবে তাঁর সৌভাগ্য যে তিনি শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা দেখেছিলেন। তাঁকে উত্তর প্রদেশের রাজ্যপাল নিযুক্ত করা হয় ভারত স্বাধীন হবার পর। সরােজিনী রাজ্যপাল হিসাবেও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ভারতের সমস্ত অঙ্গরাজ্যের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের অবস্থান একটু আলাদা। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন এই বিশাল প্রদেশটিতে। খুব একটা সহজ নয় এমন একটি রাজ্য পরিচালনা করা।

মহাত্মাগান্ধী তাঁকে নাম দিয়েছিলেন ভারতের কোকিল বা নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া। তাঁর অনেক কবিতা ফরাসি ভাষাতে অনুবাদ হয়েছিল।

লণ্ডনে তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় The Golden Threshold. এছাড়া আমরা উৎসাহের সঙ্গে পাঠ করে থাকি তাঁর অনেকগুলি কাব্যসংকলন। যেমন The feathers of the down, Bird of time এবং The broken wing.

পরবর্তীকালে কবিতা লেখার সুযোেগ এবং সময় কমে গিয়েছিল।

এইভাবেই আমাদের মনে স্মরণীয় আসন করে নিয়েছেন সরােজিনী নাইডু মুক্তমনের মানবী হিসাবে। একাধারে কবি, রাজনীতিক এবং বাগ্মী মহীয়সী। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে এই নারীর মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন –

মাদার টেরেসা | বিশ্বজননী |সেবার প্রতীক | Mother Teresa

চন্দ্রশেখর বেঙ্কটরামন | নোবেলজয়ী, স্বনামধন্য পদার্থবিজ্ঞানী | রামন এফেক্টের আবিস্কারক। C. V. Raman

2 thoughts on “সরােজিনী নাইডু | নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া |Nightingale of India| Sarojini Naidu”

Leave a Comment