সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় | রাষ্ট্রগুরু , সুবক্তা, বিপ্লবী নেতা, স্বদেশী, সুচিন্তক। Surendranath Banerjee

রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

তিনি একসময়ে ভারতমাতাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছিলেন জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে। অনমনীয় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তাই আমরা সকলে তাঁকে ভূষিত করেছি রাষ্ট্রগুরু উপাধিতে।

আমরা সবাই জানি, একদা ইংরেজ শাসন স্থাপিত হয় ভারতবর্ষের বুকে। ভারতবাসীকে শােষণ করতে শুরু করে ইংরেজ। বঞ্চার ধারাবাহিক আক্রমণ শুরু হয় সুশাসনের মাধ্যমে।

ভারতবাসীদের মনে ধীরে ধীরে জাগতে শুরু করে স্বাধীনতার আকাঙ্খ। সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহকে অনেকে চিহ্নিত করেছেন স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম হিসেবে।

তারপর সংঘবদ্ধভাবে ভারতবাসীরা এগিয়ে এলেন। আর তাঁরা পরাধীনতার জ্বালা সহ্য করতেন না। রাজনৈতিক সত্তা দিকে দিকে জেগে উঠল। আন্দোলন এবং সংগঠনের কাজ শুরু হল।

এই সময় এক বিশিষ্ট ভারতীয় বিপ্লবী রাজনীতিবিদ হিসাবে নিজেকে স্থাপন করেছিলেন, তিনি হলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বুঝতে পেরে ছিলেন ইংরেজের কূট্ৰীতি।

ইংরেজরা জোর করে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ করতে চলেছে তিনি সেটি বুঝতে পেরেছিলেন। এইভাবে তার দ্বিখণ্ডিত করতে চায় বাঙালি জাতিসত্তাকে।

তৈরি করতে চায় সাম্প্রদায়িক অনৈক্যের আবহ। তিনি রুখে দাঁড়ালেন এই অভিসন্ধির বিরুদ্ধে। বিরাট আন্দোলন গড়ে তুললেন।

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর। তাঁর বাবার নাম দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি একজন নামকরা চিকিৎসক ছিলেন। কোনাে অভাব ছিল না সংসারে।

বলা যেতে পারে, সুরেন্দ্রনাথের ছােটোবেলা অতিবাহিত হয় সচ্ছল পরিবেশের মধ্যেই। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এক নিমেষে শেষ করে ফেলতেন পাঠ্যবই। তাঁর তৃষ্ণা এতেমিটতাে ।

পৃথিবীতে পড়ার মতাে অনেক বিষয় আছে, সুরেন্দ্রনাথ সে সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। স্কুল কলেজের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করতেন।

পড়াশােনার টেবিলে বসলে মনে হত তিনি যেন অন্য কোথাও চলে গেছেন। তাঁর নিষ্ঠা এবং সংকল্প ছিল। তিনি ছােটোবেলা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন যে করেই ‘।

হােক পড়াশােনায় ভালাে হতে হবে। তাঁর মনে স্বদেশ চিন্তার উন্মেষ দেখা যায় তখন থেকেই। স্বদেশী আন্দোলন তখনও পর্যন্ত সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। তৈরি হয়নি জাতীয়তাবাদী সংগঠন।

বিক্ষিপ্ত এবং বিচ্ছিন্নভাবে দু-একজন মানুষ এখানে সেখানে স্বদেশ চিন্তার জাল বুনতে শুরু করলেন। দেখা যাচ্ছে ক্রমশ। বাড়ছে তাদের অনুগামীদের সংখ্যা।

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর এই সময় থেকে শুরু হল রাজনৈতিক জীবন। সুরেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন তিনি কলেজের পড়া শেষ করবেন। তারপর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবেন।

শাসন বিভাগে উচ্চপদ লাভ করতে পারবেন এই পরীক্ষায় পাশ করতে পারলে। তাহলে দেশের মানুষের সংস্পর্শে আসা যাবে। স্বাধীনতার স্বপ্নে দীক্ষিত করা সম্ভব হবে দেশের মানুষকে।

কিন্তু এই পরীক্ষায় তাঁকে বসার অনুমতি দেওয়া হল না। বলা হল, এই পরীক্ষায় বসতে গেলে যে বয়সসীমা থাকা দরকার, তিনি তা অতিক্রম করেছেন। সুরেন্দ্রনাথ মানতে রাজি হলেন না কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত।

তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানালেন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। তাতেও কোনাে কাজ হল না। এই অবস্থা অন্য কেউ হলে হয়তাে মেনে নিতেন। কিন্তু লৌহ কঠিন মানুষ ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ।

এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি মামলা শুরু করলেন। বিলেতের আদালতে এই মামলা দায়ের করা হল। শেষ পর্যন্ত সুরেন্দ্রনাথ জিতে গিয়েছিলেন এই মামলাতে।

কীভাবে মামলায় জয়যুক্ত হলেন একজন কালা আদমি, ভাবতেও অবাক লাগে। আসলে এতগুলাে নথিপত্র সুরেন্দ্রনাথের হাতে ছিল যে, না বলতে পারেননি ব্রিটিশ বিচারক। শেষ অবধি সুরেন্দ্রনাথকে পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেওয়া হল।

এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া মােটেই কঠিন হল না সুরেন্দ্রনাথের পক্ষে। তিনি সাফল্য লাভ করলেন সীমিত সময়ের মধ্যেই। এবার তাঁর কর্মজীবন শুরু হবে।

সরকার তাঁকে নিয়ােগ করলেন শ্রীহট্ট জেলার সহকারি জেলাশাসক হিসাবে। তিনি শ্রীহট্ট জেলাতে চলে এলেন। তখন সাদার্ণল্যান নামে এক ইংরেজ ওই জেলার শাসক ছিলেন।

তিনি বুঝতে পারলেন সুরেন্দ্রনাথকে বশে রাখা সম্ভব হবে না। ব্যক্তিত্বের সংঘাত দেখা দিল দু’জনের মধ্যে। সুরেন্দ্রনাথ সত্যবাদী ছিলেন। অন্যায়-এর সাথে কখনাে আপােস করেননি।

তিনি স্বাধীনচেতা ছিলেন। অনেক ব্যাপারে তাঁর মতানৈক্য দেখা দিল জেলাশাসক সাদার্নল্যানের সাথে। দু’জনের মধ্যে খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে গণ্ডগােল বেঁধে যেত।

একদিন দেখা দিল দুজনের মধ্যে চরম মত পার্থক্য। সুরেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযােগ এনে মামলা দায়ের করলেন সাদার্নল্যান। সুরেন্দ্রনাথ এই মামলার ফলে বাধ্য হলেন পদত্যাগ করতে। তবুও ভেঙে পড়লেন না তিনি।

তিনি বুঝতে পারলেন, কোনাে লাভ নেই, এইভাবে সরকারের বশংবদ হয়ে বেঁচে থাকার। এখন জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। মনে মনে স্বাধীনতা অনেকেই চাইছে, কিন্তু মুখ ফুটে সেকথা প্রকাশ করতে পারছে না।

সাহস আনতে হবে মানুষের মধ্যে। তিনি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর মেলে দিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সুরেন্দ্রনাথ কতখানি তেজস্বী পুরুষ ছিলেন তার প্রমাণ আছে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া একাধিক ঘটনার মধ্যে।

তিনি প্রবন্ধ লিখলেন হাইকোর্টের বিচারপতির সমালােচনা করে। কীভাবে বিচার ব্যবস্থাকে টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে ব্রিটিশরা তা এই প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি বােঝাতে চেষ্টা করলেন।

তখন নবিস সাহেব ছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি। তিনি অন্যায়ভাবে অনেক কাজ করতেন।

শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের তুষ্ট করার জন্য। সুরেন্দ্রনাথ প্রত্যেকবারই মুখর হতেন এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। ওই যুবকের এমন স্পর্ধাকে মানতে পারল না ইংরেজ সরকার।

তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করল। বলা হল, তিনি উসকানিমূলক লেখার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে খেপিয়ে তুলছেন। তিনি একজন রাজদ্রোহী। তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হল দু’মাস।

তিনি কারাবরণ করলেন হাসিমুখে। জনগণ একেবারে অবাক হয়ে গেলেন তাঁর তেজস্বিতা দেখে। একজন যথার্থ নেতার জন্ম হয়েছে তা জনগণ বুঝতে পারলেন।

তখন মানুষ উন্মাদ হয়ে উঠেছে পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। অসন্তোষ দেখা দিয়েছে চারিদিকে। সুরেন্দ্রনাথ আপ্রাণ চেষ্টা করেন এই অসন্তোষকে কাজে লাগাবার জন্য।

গণবিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল তাদের মনে স্বাধীনতা মূলক মুক্তি চিন্তা জাগিয়ে তােলাই। কিন্তু গণবিপ্লবের উপযােগী পরিমণ্ডল, তৈরি হয়েছে কি? মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে দেশের বিভিন্ন জায়গাতে গিয়ে।

অন্ধকারে ঢাকা বেশীর ভাগ মানুষের মন। তারা বুঝতেই পারছে না কী কী কুফল আসতে পারে ইংরেজ শাসনকালে।

সুরেন্দ্রনাথ একটি সমিতি তৈরি করলেন। সেই সমিতির নাম দেওয়া হল ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশন। ধীরে ধীরে এটি এক মস্ত বড়াে সংগঠনে পরিণত হয়।

অনেকেই বলে থাকেন কংগ্রেসের জয়যাত্রা শুরু হয়ে ছিল এই ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশন বা ভারতসভা থেকেই।

১৯০৫ সালে ইংরেজরা বঙ্গজননীকে দ্বিখণ্ডিত করে বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্তিমিত করার জন্য। এই প্রস্তাব করা হয়েছে নাকি শাসনকার্যের সুবিধার জন্যে।

সারাদেশে আগুন জ্বলে উঠল এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের। দেখা দিল ব্যাপক গণ অভ্যুত্থান বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন এই আন্দোলনের নেতা। এইভাবেই তিনি মন জয় করতে পেরেছিলেন দেশের সমস্ত মানুষের।

ইংরেজ সরকার স্তম্ভিত হয়ে গেল ওই মহামানবের দৃঢ় সংকল্প দেখে। বাধ্য হয়ে তারা বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব তুলে নিল। সুরেন্দ্রনাথ-এর স্বপ্ন সার্থক হল।

এর পরেও সুরেন্দ্রনাথ যুক্ত ছিলেন নানা জায়গাতে নানা ধরণের কল্যাণকামী কাজের সঙ্গে। তিনি ছিলেন অসম্ভব ভালাে বক্তা। অতি সহজেই দর্শকদের কাছে টানতে পারতেন।

যুক্তির মাধ্যমে এক একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে সকলের সামনে ঘােষণা করেন ইংরেজ সরকারের অপদার্থতার কথা। ১৯২৫ সালের ৬ আগষ্ট এই মহানেতা অমৃতলােকের পথে যাত্রা করেন।

আরও পড়ুন –

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ – আইনবিশারদ, ব্যারিস্টার, দেশপ্রেমিক। Chittaranjan Das | Indian lawyer

শ্রী অরবিন্দ ঘােষ | ঋষি, সুসাহিত্যিক এবং বিদগ্ধ প্রবন্ধকার | অগ্নিযুগের মহানায়ক | আধ্যাত্মিক সাধনার সিদ্ধপুরুষ। Sri Aurobindo

1 thought on “সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় | রাষ্ট্রগুরু , সুবক্তা, বিপ্লবী নেতা, স্বদেশী, সুচিন্তক। Surendranath Banerjee”

Leave a Comment