প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার | Pritilata Waddedar

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

‘মুক্তির মন্দির-সােপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান…’। গানটি শুনলেই আমাদের দু’চোখের সামনে আঁকা হয়ে যায় একটা ফাঁসির মঞ্চ আর বীর। শহিদের আত্মদানের মুহূর্ত।

কিন্তু সেদিনের সেই মুক্তি আন্দোলনে যােগদান। করে মেয়েরাও যে শহিদ হয়েছেন, সে খবর বিশেষ করে জানা দরকার। এমন এক নারী শহিদের নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

প্রীতিলতা জন্মেছিলেন বাংলাদেশের চট্টগ্রামে-১৯১১ খ্রিস্টাব্দে। মৃত্যুবরণ করলেন ১৯৩২-এ। মাত্র বাইশটা বছর বেঁচে থেকে অমর হয়ে গেলেন ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে পরাধীন ভারতবর্ষের সংগ্রামের ইতিহাসে।

প্রীতিলতার সময়ে চট্টগ্রামে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানাের তেমন চল ছিল না। বাড়ির দাদারা যথারীতি মাস্টার মশায়দের কাছে পড়াশােনা করত।

তা দেখে জেদি মেয়ে পড়াশােনা করতে চাইল। প্রীতিলতার লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে দাদারা মাস্টারমশায়রাও তাকে কাছে ডেকে নিতেন। তাঁরা বুঝতে পারেন, মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমতী।

অবশেষে প্রীতিলতার আগ্রহে সাত বৎসর বয়েসে তাঁকে একটি স্কুলে ভরতি করে দেওয়া হয়।

ঢাকায় তখন লীলা নাগের দীপাবলী সঙেঘর যথেষ্ট নাম। সেই প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে দেশের প্রতি মেয়েদের কর্তব্যর কথা মনে করিয়ে দেওয়া হত।

পরে কলকাতায় আসার পরে কল্যাণী দাসের প্রচেষ্টায় গড়ে তােলা ছাত্রী সঙেঘও প্রীতিলতা তাঁর নাম লেখালেন।চট্টগ্রাম আর কলকাতার দুটি সঙঘই প্রীতিলতার অন্তরে দেশের প্রতি কর্তব্য এবং সেবার মনােভাব সুন্দরভাবে গড়ে দিয়েছিল।

সেই প্রেরণাই তাঁর পরবর্তী জীবনে তাঁকে পরাধীন দেশের যথার্থ সেবিকা হিসাবে গড়ে তুলেছিল।

প্রীতিলতা তখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী। গল্প-উপন্যাসের বই তাঁকে তেমন করে টানত না। কিন্তু বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ইতিহাস আর বিপ্লবীদের জীবনী পড়তে খুব ভালােবাসতেন।

বইগুলি পড়তে পড়তে তিনি আরও ভালাে করে বুঝলেন, তাঁর দেশের মুক্তি-বিপ্লবে মেয়েদেরও অনেক কিছু করার আছে। তিনি সে বিষয়ে লেখার জন্যে কলম ধরলেন।

ছাত্রী হিসাবেও তিনি কত মেধাবী তারও প্রমাণ রাখলেন ১৯৩০ সালে ঢাকা বাের্ডের পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থানটি দখল করে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ডিস্টিংশন নিয়ে বি.এ. পাস করলেন।

কলকাতায় অবস্থান কালেই তিনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন স্বাধীনতা আন্দোলনে যােগদানের জন্যে। যােগাযােগও ঘটে গেল। চট্টগ্রামে তখন যুগান্তর’ নামে এক শক্তিশালী আন্দোলন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

ওই দলেরই সূর্য সেনের (যাকে আমরা মাস্টারদা’ বললেই বেশি চিনতে পারি) সঙ্গে প্রীতিলতার যােগাযােগ ঘটে যায়। তখন রামকৃষ্ণ দাস নামে এক বিপ্লবী ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আলিপুর জেলে রয়েছেন।

তারিণী মুখার্জি নামে দেশের এক বিশ্বাসঘাতককে হত্যা করার জন্যে রামকৃষ্ণের এই কারাবাস। ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে প্রাণ দিতে হবে।

এমন একজন বিপ্লবীর সঙ্গে আলিপুর জেলে যােগাযােগের জন্যে সূর্য সেন প্রীতিলতাকে দায়িত্ব দেন। প্রীতিলতা এই রামকৃষ্ণ দাসের সঙ্গ লাভ করে মনেপ্রাণে একজন মহিলা বিপ্লবী হয়ে উঠলেন।

প্রীতিলতা ভাবলেন বিপ্লবের আগুনকে আরও বহু মেয়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারলে দেশ পুরােপুরি জাগবে না। মেয়েরা শুধু স্বামী-পুত্র নিয়ে ঘর সংসার করার জন্যে জন্মায়নি, দেশের বৃহত্তর ক্ষেত্রে পুরুষদের মতাে তাদেরও ভূমিকা আছে, তা তাদের বােঝাতে হবে।

ঠিক এই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি কলকাতা থেকে ফিরে গেলেন চট্টগ্রামে। সেখানে তিনি নন্দন কানন গার্লস স্কুল নামে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষিকার পদ গ্রহণ করলেন। আর শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে দেশকে বিদেশি শাসন মুক্ত করার মন্ত্র শেখাতে লাগলেন ছাত্রীদের।

এই সময় প্রীতিলতা খবর পেলেন ধলঘাট নামে এক গ্রামে সূর্য সেন তাঁর দলের নির্মল সেন আর অপূর্ব সেনদের নিয়ে সাবিত্রী দেবী নামে এক ভদ্রমহিলার বাড়িতে আত্মগােপন করে আছেন। প্রীতিলতা ঠিক করলেন, যেমন করেই হােক মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সরাসরি স্বাধীনতা যুদ্ধে কোনও দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার চেয়ে নেবেন।

ইংরেজ পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে সেখানে যাওয়া বড়াে কঠিন। কারণ প্রীতিলতাকে তারা সন্দেহ করে। তাঁর কার্যকলাপ ইংরেজ পুলিশের কানে পৌছেছে।

তাই পুরুষের ছদ্মবেশে প্রীতিলতা সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে হাজির হলেন। নির্মল সেন সূর্য সেনকে অনুরােধ করলেন, যাতে প্রীতিলতা দেশের এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারেন। সুর্য সেন রাজি হলেন।

১৯৩২ সালের ১২ই জুন রাত্রি আটটায় খবর পেয়ে ইংরেজ পুলিশ সাবিত্রী দেবীর বাড়ি ঘিরে ফেললেন। তখন নীচের ঘরে সূর্য সেন, নির্মল সেন, অপূর্ব সেন আর প্রীতিলতা আগামী কর্মসূচী সম্বন্ধে আলােচনা করতে করতে খেতে ব্যস্ত।

বাইরে ইংরেজ পুলিশের বুটজুতাের শব্দে এই বিপ্লবীর দল তাঁদের বিপদের কথা বুঝে ফেললেন। সেই দলে ছিল ক্যাপ্টেন ক্যামেরন সাহেব। বিপ্লবীরা দোতলায় উঠে যাওয়ার ব্যাপারটা টের পেয়ে তিনিও দোতলায় উঠে যেতে ব্যস্ত ছিলেন।

কিন্তু তিনি নির্মল সেনের গুলির আঘাতে উলটে পড়লেন সিঁড়িতেই। নির্মল সেন পালিয়ে যাবার জন্যে নীচের টিনের চালে লাফিয়ে পড়তেই গাের্খাপুলিশের বন্দুকের নিশানার মুখে তাঁকে প্রাণ দিতে হল।

ততক্ষণে নীচে নেমে বাড়িটির পাশের জঙ্গলের মধ্যে দৌড়ে পালাতে গিয়ে শুকনাে পাতার শব্দ লক্ষ করে ইংরেজ পুলিশ গুলি চালাল।

অপূর্ব সেনকেও অকালে প্রাণ দিতে হল। কোনওরকমে পালিয়ে বাঁচলেন সূর্য সেন আর প্রীতিলতা।

এর পর একদিন প্রীতিলতা তাঁর বিপ্লবী গুরু সূর্য সেনকে বললেন, ‘দাদা, আপনি আমাকে একটা কঠিন দায়িত্ব দিন, যা পালন করার পরে আমি হাসতে হাসতে শহিদ হতে পারি।

সূর্য সেনের নির্দেশে বাহিনী নিয়ে পাহাড়তলির ইউরােপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করলেন প্রীতিলতা। রাতের আমােদের আসরে সমবেত হয়েছিলেন বেশ কিছু ইংরেজ কর্তাব্যক্তির দল।

প্রীতিলতা প্রাণ বাজি রেখে এলােপাথাড়ি গুলি চালিয়ে সে রাতে বেশ কিছু লালমুখাের প্রাণ নিতে পেরেছিলাে। তবে ইংরেজ পুলিশও প্রীতিলতাকে পেয়ে গিয়েছিল নাগালের মধ্যে।

প্রীতিলতা সঙ্গে রেখেছিলেন পটাশিয়াম সায়ানাইড। অতি সহজে তা খেয়ে তিনি শহিদ হলেন। বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, মেয়েরাও বিপ্লবী হয়ে দেশের স্বাধীনতা যজ্ঞে অক্লেষে প্রাণকে আহুতি দিতে পারে।

admin

I am Asis M Maiti. I am currently working in a private institution. After completion of my academic so far I am learning about many new concepts. Try to circulate these to the people nearby. To explore my thinking to worldwide I am in the world of blogging. Love to eat, travel, read.Love to explore various movies. You will not be bored here.Keep in touch.You are inspiration to me.

Leave a Comment