ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
সুনীতিকুমার যে শুধু একজন ভাষাতাত্ত্বিক ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন সর্বার্থে একজন শিক্ষাব্রতী। তাঁর একান্ত ইচ্ছে ছিল বাংলা ভাষায় যেন বিজ্ঞানসম্মত চর্চা শুরু হয়। শুধু তাই নয়, মানবসংস্কৃতির এমন কোনো বিষয় নেই, যার সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ ছিল না। সারা জীবন ধরে পরিশুদ্ধ সারস্বত চিন্তা করে গেছেন। তিনি জীবনব্যাপী সাধনার মাধ্যমে যেসব বই লিখেছেন, সেগুলি বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল স্বরূপ বিরাজ করছে। সুনীতিকুমারের জ্ঞান এবং মেধার পরিচয় দিতে গিয়ে দেশ-বিদেশের বুদ্ধিজীবীরা তাকে এনসাইক্লোপিডিস্ট অভিধায় ভূষিত করেছে। একজন মানুষের পক্ষে এই উপাধি যে কতখানি গৌরবের বিষয় তা হয়তো আমরা উপলব্ধি করতে পারব না।
১৮৯০ সালের ২৬ নভেম্বর সুনীতিকুমারের জন্ম হয়। তিনি জন্মেছিলেন হাওড়ার শিবপুরে তাঁর মামার বাড়িতে। বাবার নাম হরিদাস চট্টোপাধ্যায়, মায়ের নাম কাত্যায়নী দেবী।
সুনীতিকুমারের শৈশবের দিনগুলি কেটে যায় উত্তর কলকাতার কৈলাস বসু স্ট্রিটে। সুনীতিকুমাররা চারবোন দুই ভাই। ভাইবোনেদের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজো। পাঁচ বছর বয়সে দাদার সঙ্গে পাড়ার পাঠশালায় পড়তে যান।
শহরের উত্তরাঞ্চল স্বভাবতই রক্ষণশীল। এই অঞ্চলেই সুনীতিকুমারের বাল্য এবং প্রথম কৈশোরের দিনগুলো অতিবাহিত হয়। পাঠশালার জীবন কেমন ছিল -সে সম্পর্কে সুনীতিকুমার লিখেছেন—“ যেদিন সকালে মা বললেন, ‘আজ থেকে তুমি পাঠশালায় যাবে’ তখনকার দিনের রেওয়াজ মতো তালপাতার পাততাড়ি নিয়ে যেত। হাতে দড়ি ঝোলানো মাটির দোয়াত, তাতে চাল পুড়িয়ে হিরাকস আর কেশর মিলিয়ে মায়ের হাতের তৈরি কালি থাকত। তাতে কালি চলকে পড়ত না। আর সঙ্গে থাকত খাগের একটি কলম। বোধহয় তখনও শ্লেটের প্রচলন হয়নি।
…এই পাতাড়ি দড়ি দিয়ে বেঁধে আর পড়বার বই বর্ণমালা প্রথম ভাগ কী দ্বিতীয় ভাগ আর ধারাপাত, একটা ছোটো আসনে বা মাদুরে জড়িয়ে নিয়ে দাদা পাঠশালায় যেত।
আমাদের সময় ছোটো ছেলেদের হাফপ্যান্ট পরার রেওয়াজ ছিল না। পাঁচ থেকে ছয়, সাত, আট বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেরা হয় ধুতি পরত, নয় দিগম্বর হয়ে বেড়াত।
… আমাদের গায়ে ছিটের কামিজ আর গলাবন্ধ কোট ছাড়া অন্য জামা উঠত না। দাদা কাপড় আর জামা পরে আর নতুন পাততাড়ি নিয়ে যেদিন দাদার পাঠশালায় গেলাম, সেদিনের অস্পষ্ট স্মৃতি কিছু কিছু মনে আছে।
পাঠশালা বাড়ির ভেতরে গিয়ে মনটা একটু দমে গেল, অতি সাধারণ গোলপাতায় ছাওয়া কুঁড়ে কতগুলি। রাস্তার উপরে মুটে মজুররা থাকত সেখানে। গুরুমশাই তাঁর স্ত্রী আর ছেলেপুলে নিয়ে উঠানের পাশে একটি ঘরে থাকতেন। আর দু-তিন খানি ঘরে অন্য ভাড়াটে থাকত। গুরুমশাইয়ের সামনে উঠানের উপরে দু-তিন সার ছেলে নিজেদের আসন-মাদুর লম্বা সার দিয়ে বসত। সামনে তাদের পাততাড়ি আর দোয়াত-কলম।
… আমি দাদার সঙ্গে গিয়ে দাঁড়ালুম। ঝি গিয়ে গুরুমশাইকে বলে দিলে যে, আজ থেকে আমি পাঠশালায় ভর্তি হলাম।
… গুরুমশাই বেশ খুশিই হলেন। তারপর আমাকে ডেকে উৎসাহ দিলেন— ‘বেশ বেশ, আজ থেকে রোজ পাঠশালায় আসবে আর আসবার সময় কান্নাকাটি করবে না, আর মন দিয়ে পড়বে। নইলে এই বেত মেরে হাড় এক জায়গায়, মাস এক জায়গায় করব।’
… গুরুমশায়ের এই কথায় বড়ো ভয় হল। আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, মন দিয়ে ভালো করে পড়ব। তারপর দাদার পাশে এসে বসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম৷
এইভাবে এক অতিসাধারণ পরিবেশে সুনীতিকুমারের বিদ্যাচর্চা শুরু হয়। ভাবতে অবাক হতে হয় পরবর্তীকালে যিনি সারা ভারতের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী হিসাবে স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর শিক্ষা শুরু হয়েছিল অত্যন্ত সাধারণভাবে। এই পাঠশালায় কিছুদিন পড়াশোনা করার পর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দু’বছরের জন্য ক্যালকাটা অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। তারপ্র আসেন মতিলাল শীলের ফ্রি স্কুলে।
শৈশবে অনেক কষ্ট করে তাঁকে পড়াশোনা শিখতে হয়েছিল। ছোটো থেকেই তাঁর চোখে রোগ ছিল তাই ভালো করে দেখতে পেতেন না। এজন্য চশমা নিতে হয়েছিল।
অন্য ছেলেদের মতো দৌড়ঝাঁপ করে খেলাধূলা করতে পারতেন না। শারীরিক কারণেই হয়তো তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর একটা নিজস্ব জগৎ ছিল, সেই জগতে বই ছিল রোজকার সাথি। বইয়ের জগতে ডুব দিয়ে তিনি যে আনন্দ পেতেন তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন সুনীতিকুমার। একবার যা পড়তেন তা মনের ভেতর গেঁথে যেত। কখনো তা ভুলতেন না। এমন মেধাশক্তি চট করে নজরে পড়ে না। পরিণত বয়সেও তাঁর এই মেধা ও মনন শক্তি অক্ষুণ্ন ছিল।
ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়ে ছোটো বেলায় নিজের চেষ্টায় আঁকতে শিখেছিলেন। আঁকার হাত ছিল খুবই ভালো।
হাতের মুঠি অথবা ঘোড়ার ক্ষুর আঁকা অত সহজ নয়, বালক সুনীতিকুমার এই ধরণের শক্ত বিষয়গুলি অনায়াসে আঁকতে পারতেন।
তাঁর চোখ ভালো থাকলে হয়তো আমরা এক চিত্রশিল্পী সুনীতিকুমারকে দেখতে পেতাম।
ছবি আঁকার মধ্যে তাঁর ভবিষ্যতের জীবনটি প্রচ্ছন্ন ছিল। ছবির মূল কথা হচ্ছে রেখাঙ্কন।
বিভিন্ন হরফের অপরিচিত রেখার টান সুনীতিকুমারের মনকে বরাবর আকৃষ্ট করত।
এইভাবেই হরফের হাত ধরে ভাষার জগতে প্রবেশ করলেন সুনীতিকুমার। বুঝতে পারলেন এই জগতে কত রহস্য আর রোমাঞ্চের হাতছানি। মানুষের মুখের ভাষা আর লেখার ভাষার মধ্যে কত তফাৎ। বাংলা ভাষার সাথে ইংরাজি—ভাষার কী কী মিল; আর কী কী অমিল আছে, আর কেন আছে, তা জানতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। পরবর্তীকালে সুনীতিকুমার এসব বিষয় নিয়ে যথেষ্ট চর্চা করেছেন, হয়ে উঠেছেন এক বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ। মতিলাল শীলের ফ্রি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার
করলেন। ভরতি হলেন স্কটিশচার্চ কলেজে।
ভাষাতাত্ত্বিক এবং বহুভাষাবিদ সুনীতিকুমারের খ্যাতি ধীরে ধীরে দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি লিখলেন Original Development of the Bengali Language নামে বিখ্যাত বই। এই বই দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। লণ্ডন থেকেও তাঁর বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে Indo-Aryan and Hindi Bengali Phonetic Reader প্রভৃতি প্রধান।
১৯২৭ সালের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী হিসাবে সুমাত্রা, জাভা, বোনিও, শ্যামদেস পরিভ্রমণ করেন। বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিয়ে রচিত হল ‘দ্বীপময় ভারত’ নামে একটি অসাধারণ তথ্য সমৃদ্ধ রই।
ভাষাতত্ত্বের বিভিন্ন সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। গেছেন ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। একাধিক সেমিনারে অংশ নিয়েছেন।
১৯৫২-৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি বিধান পরিষদে অধ্যক্ষ ছিলেন। ভারত সরকার তাঁকে ১৯৬৩ সালে পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। ১৯৬৯ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলা সাহিত্যে তিনি ছিলেন এক উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধকার। যথেষ্ট পরিশ্রম করে প্রবন্ধ বইগুলি লিখেছেন। চণ্ডীদাস পদাবলীর প্রামাণ্য সংস্করণ সম্পাদনা করেছেন। বিশ্ব সাহিত্যের পটভূমিকায় রবীন্দ্র সাহিত্যের বিচার সম্পর্কে লেখা তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থটি আজও কৌতূহলের সঙ্গে পাঠ করা হয়। ভাবতে অবাক লাগে যে, সুনীতিকুমার তিনশোটিরও বেশি পাণ্ডিত্যমূলক প্রবন্ধ গ্রন্থ লিখে গেছেন। ১৯৭৭ সালের ২৯ মে এই ভাষাবিজ্ঞানীর জীবনাবসান হয়।
আরও পড়ুন –
রাহুল সংকৃত্যায়ন – বহুভাষাবিদ, পঙ্গু ও ভন্ড সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক অনন্য লেখক। Rahul Sankrityan
শিবনাথ শাস্ত্রী – সাহিত্য জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, পুরোধা পুরুষ।
1 thought on “সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় | ভাষাতাত্ত্বিক এবং বহুভাষাবিদ | এনসাইক্লোপিডিস্ট | Suniti Kumar Chatterji”