বোকা জোলা আর শিয়ালের কথা
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
এক বোকা জোলা ছিল। সে একদিন কাস্তে নিয়ে ধান কাটতে গিয়ে খেতের মাঝখানেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম থেকে উঠে আবার কাস্তে হাতে নিয়ে দেখল, সেটা বড্ড গরম হয়েছে।
কাস্তেখানা রোদ লেগে গরম হয়েছিল, কিন্তু জোলা ভাবল তার জ্বর হয়েছে। তখন সে ‘আমার কাস্তে তো মরে যাবে রে!’ বলে হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগল।
পাশের খেতে এক চাষা কাজ করছিল। জোলার কান্না শুনে সে বললে, ‘কী হয়েছে?’
জোলা বললে, ‘আমার কাস্তের জ্বর হয়েছে।’
তা শুনে চাষা হাসতে হাসতে বললে, ‘ওকে জলে ডুবিয়ে রাখো, জ্বর সেরে যাবে।’
জলে ডুবিয়ে কাস্তে ঠান্ডা হল। জোলাও যার-পর-নাই সুখী হল!
জোলার মায়ের জ্বর হয়েছে। সকলে বললে, ‘বদ্যি ডাক।’ জোলা বললে, ‘আমি ওষুধ জানি।’ বলে, সে তার মাকে পুকুরে নিয়ে জলের ভিতরে চেপে ধরল। সে বেচারি যতই ছটফট করে জোলা ততই আরও চেপে ধরে, আর বলে, ‘রোসো, এই তো জ্বর সারছে।’
তারপর একদিন
তারপর যখন বুড়ি আর নড়ছে না, তখন তাকে তুলে দেখে সে মরে গেছে। তখন জোলা চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল। তিন দিন কিছু খেল না, পুকুরপাড় থেকে ঘরেও গেল না।
এক শিয়াল সেই জোলার বন্ধু ছিল। সে জোলাকে কাঁদতে দেখে এসে বললে, ‘বন্ধু, তুমি কেঁদো না, তোমাকে রাজার মেয়ে বিয়ে করাব।’
শুনে জোলা চোখ মুছে ঘরে গেল। তারপর থেকে সে রোজ শিয়ালকে বলে, ‘কই বন্ধু, সেই যে বলেছিলে?’
শিয়াল বললে, ‘যখন বলেছি, তখন করাবই। আগে তুমি খানকতক খুব ভালো কাপড় বুনগে দেখি।’
জোলা দু-মাস খালি কাপড়ই বুনল। তারপর শিয়াল তাকে খুব করে সাবান মেখে স্নান করতে বলে, রাজার কাছে মেয়ে চাইতে বেরুল।কানে কলম গুঁজে, পাগড়ি এঁটে, জামা-জুতো পরে, চাদর জড়িয়ে, ছাতা বগলে করে, শিয়াল যখন রাজার নিকট উপস্থিত হল তখন রাজামশাই ভাবলেন, এ খুব পণ্ডিত লোক হবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী শিয়ালপণ্ডিত, কী জন্যে এসেছ?’
শিয়াল বললে, ‘মহারাজ, আমাদের রাজার সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ে দেবেন কি না তাই জানতে এসেছি।’
শিয়াল মিছে কথা বলেনি, সেই জোলার নাম ছিল ‘রাজা’। কিন্তু রাজামশাই মনে করলেন বুঝি সত্যি-সত্যিই রাজা। তিনি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের রাজা কেমন?’
শিয়াল বললে—
‘দেখতে রাজা বড়োই ভালো
ঘরময় তার চাঁদের আলো।
বুদ্ধি তার আছে যেমন
লেখাপড়া জানে তেমন।
এক ঘায় তার দশটা পড়ে
তার গুণে লোক খায় পরে।’
সত্যি সত্যিই সে জোলা দেখতে ভারি সুন্দর ছিল তাই শিয়াল বললে, ‘দেখতে বড়োই ভালো।’
তার ঘরে চাল ছিল না বলে ভিতরে চাঁদের আলো আসত, তাই শিয়াল বললে, ‘ঘরময় চাঁদের আলো।’ কিন্তু রাজামশাই ভাবলেন, বুঝি সেটা তাঁর নিজের বাড়ির মতন খুব ঝকঝকে জমকালো একটা বাড়ি।
বুদ্ধি তার ছিল না, আর সে লেখাপড়াও জানত না। কাজেই শিয়াল বললে, ‘বুদ্ধি তার আছে যেমন, লেখাপড়া জানে তেমন।’ কিন্তু রাজা ভাবলেন, তার ভারি বুদ্ধি, সে ঢের লেখাপড়া জানে।
‘এক ঘায়, তার দশটা পড়ে’ এ কথাও সত্যি। দশটা মানুষ নয়, দশটা ধানের গাছ! সে চাষা ছিল, কাস্তে নিয়ে ধান কাটত। রাজামশাই কিন্তু ভাবলেন, সে মস্ত বড়ো বীর, তার এক ঘায় দশজন মানুষ মরে যায়।
সে ধানের চাষ করত আর কাপড় বুনত। ধান থেকেই তো ভাত হয়, তাই লোকে খায়; আর কাপড় পরে। তাই শিয়াল বললে, ‘তার গুণে লোক খায় পরে।’ রাজামশাই কিন্তু সেইসময় বুঝলেন না। তিনি ভাবলেন বুঝি সে ঢের গরিব লোককে খেতে পরতে দেয়।
কাজেই তিনি যারপরনাই খুশি হয়ে শিয়ালকে এক হাজার টাকা বকশিশ দিলেন, আর বললেন, ‘এমন লোকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেব না তো কার সঙ্গে দেব? তোমার রাজাকে নিয়ে এসো, আট দিনের পর বিয়ে হবে।’
শিয়াল সেই হাজার টাকার থলে বগলে করে, নাচতে নাচতে জোলার কাছে এল। এসে দেখে, জোলা খালি কাপড়ই বুনছে। দু-মাসে সে এত কাপড় বুনেছে যে সেই গ্রামের সকলের এক-একখানি করে কাপড় হতে পারে।
শিয়াল সেই টাকার থলে থেকে দুটি করে টাকা আর এক-একখানি কাপড় গ্রামের সকলকে দিয়ে বললে, ‘আট দিন পরে রাজার মেয়ের সঙ্গে আমাদের বন্ধুর বিয়ে হবে, আপনাদের নিমন্ত্রণ।’ শুনে তারা ভারি খুশি হল। জোলা বোঁকা হলেও বড়ো ভালোমানুষ ছিল, তাই সকলে তাকে ভালোবাসত।
তারপর শিয়াল আর সব শিয়ালের কাছে গিয়ে বলল, ‘ভাইসকল, আমার বন্ধুর বিয়ে, তোমাদের নিমন্ত্রণ। তোমরা গান গাইতে যাবে।’
যাব, যাব।’ তারপর শিয়াল ব্যাংদের কাছে গিয়ে বললে, ‘ভাইসকল, আমার বন্ধুর বিয়ে, তোমাদের নিমন্ত্রণ। তোমরা গান গাইতে যাবে।’
শুনে শিয়াল সব হোয়া-হোয়া করে বললে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ,যাব, যাব।’
সকল ব্যাং ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বললে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ যাব, যাব!’ তারপর শিয়াল শালিকদের কাছে গিয়ে বললে, ‘ভাইসকল, আমার বন্ধুর বিয়ে, তোমাদের নিমন্ত্রণ। তোমরা গান গাইতে যাবে।’
শালিকের দল কিচির-মিচির করে বললে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাব, যাব।’
তারপর শিয়াল হাঁড়িচাচাদের কাছে, ঘুঘুদের কাছে, কুঁক্কো পাখিদের কাছে, উৎক্রোশ পাখিদের কাছে, বউ-কথা-ক-দের কাছে, ময়ূরদের কাছে, চোখ-গেলদের কাছে, আর ভগদত্তদের কাছে গিয়েও তেমনি করে নিমন্ত্রণ করে এল। তারা সবাই বললে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাব, যাব।’
এ সব কাজ শেষ হতে সাতদিন লাগল। তার পরের দিন রাত্রিতে বিয়ে। শিয়াল তার বন্ধুর জন্যে চমৎকার পোশাক ভাড়া করে এনে যখন সেই পোশাক তাকে পরিয়ে দিল, তখন সত্যি সত্যিই তাকে খুব বড়ো একটা রাজার মতন মনে হতে লাগল। যাদের নিমন্ত্রণ, তারাও সবাই এল। যাবার সময় হলে, শিয়াল তাদের সবাইকে নিয়ে রাজার বাড়ি চলল।
রাজার বাড়ি যখন এক ক্রোশ দূরে আছে, তখন শিয়াল সকলকে ডেকে বললে, ‘ভাইসকল, ওই দেখো রাজার বাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। তোমরা ওই আলো দেখে খুব ধীরে ধীরে এস। আমি ততক্ষণ ছুটে গিয়ে রাজামশাইকে খবর দি। .
সবাই বললে, ‘আচ্ছা।’
শিয়াল বললে, ‘তবে একবার তোমরা সবাই মিলে গান ধরো তো! দেখি কার কেমন গলার জোর!’
অমনি পাঁচ হাজার শিয়াল মিলে চ্যাঁচাতে লাগল, ‘হুয়া, হুয়া, হুয়া!’ বারো হাজার ব্যাং বললে, ‘ঘোঁৎ, ঘোঁৎ, ঘেঁয়াও, ঘেঁয়াও!’ সাত হাজার শালিক বললে—
‘ফড়িং সঙ্গে সঙ্গে চারিজনং
চকিৎ কাট্ কাট্ কাট্ গুরুচরণ!’
দু-হাজার হাঁড়িচাচা বললে, “ঘ্যাঁচা, ঘ্যাঁচা, ঘ্যাঁচা, ঘ্যাঁচা, ঘ্যাঁচা, ঘ্যাঁচা!’ চার হাজার ঘুঘু বললে, ‘রঘু, রঘু, রঘু, রঘু, রঘু!’
তিন হাজার কুঁক্কো বললে, ‘পুৎ, পুৎ, পুৎ, পুৎ, পুৎ, পুৎ!’
উনিশশো উৎক্রোশ বললে, ‘হাঁ আঃ, হাঁ আঃ, হাঁ আঃ, ও হো হো হো হো!’ আর যত বউ-কথা-ক, ভগদত্ত আর চোখ-গেল, তারাও সবাই মিলে যার-যার গান ধরতে ছাড়ল না।
তখন শুনতে কেমন হয়েছিল তা, সেখানে থাকলে বোঝা যেত। রাজার বাড়ির লোকেরা দূর থেকে তা শুনে তো ভয়ে কাঁপতে লাগল। তারপর যখন শিয়াল রাজামশাইকে খবর দিতে এল, তখন তিনি ভারি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘শিয়াল পণ্ডিত, ওটা কীসের গোলমাল?’
শিয়াল বললেন, ‘ওটা আমাদের বাজনা আর লোকজনের শব্দ।’
শুনে রাজা তো ভয়ে অস্থির হলেন। এত লোককে কোথায় বসাবেন, কী দিয়ে খাওয়াবেন, ভেবে ঠিক করতে পারলেন না। তিনি শিয়ালকে বললেন, ‘তাই তো, কী হবে?’
শিয়াল বললে, ‘ভয় কী মহারাজ! আমি এক্ষুনি গিয়ে লোকজন সব ফিরিয়ে ‘দিচ্ছি। খালি রাজাকে আপনার কাছে আনব।’
রাজা তখন বড়োই খুশি হয়ে শিয়ালকে পাঁচ হাজার টাকা বকশিশ দিলেন। শিয়াল ফিরে এসে মাঠের মাঝখানে অনেক টাকার মুড়ি-মুড়কি, আর ছোটো-ছোটো মাছ ছড়িয়ে দিয়ে বললে, ‘তোমরা খাও।’ অমনি তার সঙ্গের সব শিয়াল, ব্যাং আর পাখি মিলে কাড়াকাড়ি করে সে সব খেতে লাগল। শিয়াল তার গ্রামের লোকদের প্রাণ ভরে সন্দেশ খাইয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। তারপর জোলাকে নিয়ে রাজার কাছে এল। আসবার সময় তাকে শিখিয়ে আনল, ‘খবরদার! কথা বলো না যেন, তবে কিন্তু বিয়ে করতে পারবে না!’
রাজার বাড়ির লোকেরা বর দেখে কী যে খুশি হল, কী বলব! তারা খালি এইজন্য দুঃখ করতে লাগল যে, এমন সুন্দর বর, কিন্তু সে কথা কয় না কেন? শিয়াল বললে, ‘ওঁর মা মরে গিয়েছেন, সেই দুঃখে উনি কথা বলছেন না। শুনে সবাই বললে, ‘আহা!’ কিন্তু আসল কথা এই যে, কথা বললেই কিনা জোলা ধরা পড়ে যাবে, তাই শিয়াল তাকে মানা করেছে।
খাবার সময় জোলাকে সোনার থালায় ভাত, আর একশোটা সোনার বাটিতে করে নানারকম তরকারি আর মিঠাই দিয়েছিল। সে এক-একটা করে সবগুলো বাটি হাতে নিয়ে শুঁকে দেখল। শেষে তার কোনোটাই চিনতে না পেরে, মিঠাই, ঝোল, অম্বল, সব একসঙ্গে ভাতের উপর ঢেলে মেখে নিল। তারপর তার খানিকটা বই খেতে না পেরে, যা বাকি ছিল চাদরে বাঁধতে গেল।
সকলে শিয়ালকে বললে, ‘তোমাদের রাজা কেন এমন? কখনো কিছু খায়নি নাকি?’
শিয়াল চোখ ঠেরে তাদের কানে কানে বললে, ‘উনি একবার বই দু-বার মেখে খান না, আর পাতে যা থাকে তা চাদরে বেঁধে সেই চাদরখানিসুদ্ধ গরিবকে দেন। একজন গরিবকে ডাক।’
বলে সে খাবার-বাঁধা চাদরখানি জোলার গায় থেকে খুলে গরিবকে দিতে দিল।
শোবার সময় জোলার ভারি মুশকিল হল। হাতির দাঁতের খাটে বিছানা, তাতে মশারি খাটানো। সে বেচারা কোনোদিন খাটও দেখেনি, মশারিও দেখেনি।
আগে গিয়ে খাটের তলায় ঢুকল, সেখানে বিছানা নেই দেখে বেরিয়ে এল। তারপর মশারির চার ধারে খুঁজে, তার দরজা টের না পেয়ে বললে, ‘বুঝেছি, ঘরের ভিতর ঘর করেছে, তার দোর রেখেছে চালের উপর!’
বলে সে খাটের খুঁটি বেয়ে যেই মশারির চালে উঠতে গিয়েছে অমনি সবসুদ্ধ ভেঙে নিয়ে ধপাৎ! তখন সে কাঁদতে কাঁদতে বললে—
‘ধান কাটতুম কাপড় বুনতুম সেই ছিল ভালো। রাজার মেয়ে বিয়ে করে মোর কোমর ভেঙে গেল।
ভাগ্যিস সেখানে আব লোক ছিল না, কেবল রাজার মেয়ে ছিলেন আর বাইরে শিয়াল বসে ছিল। রাজার মেয়ে অনেক কাঁদলেন, আর শিয়ালকে বকলেন! কিন্তু তাঁর ভারি বুদ্ধি ছিল, তাই এ কথা আর কাউকে বললেন না।
পরদিন রাজার মেয়ের কথায় শিয়াল গিয়ে রাজাকে বললে, ‘মহারাজ, আপনার জামাই বলছেন, আপনার মেয়েকে নিয়ে তিনি নানান দেশ দেখতে যাবেন। তাই ছুটি চাচ্ছেন।’
রাজা খুশি হয়ে ছুটি দিলেন, আর লোকজন টাকাকড়ি সঙ্গে দিলেন। তারপর রাজার মেয়ে জোলাকে নিয়ে আর এক দেশে গিয়ে বড়ো বড়ো মাস্টার রেখে তাকে সকলরকম বিদ্যে শেখাতে লাগলেন। দু-তিন বছরের মধ্যে জোলা মস্ত পণ্ডিত আর বীর হয়ে উঠল।
তখন খবর এল রাজা মরে গেছেন, আর তাঁর ছেলে নেই বলে জামাইকে রাজা করে গিয়েছেন।
তখন খুব সুখের কথা হল।