আবদুল কালাম – মিশাইলম্যান, আধুনিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী।

আবদুল কালাম

ভারতবর্ষের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আবদুল কালামকে মিশাইলম্যান বলা হয়ে থাকে। ১৯৩১ সালে জন্মেছিলেন তিনি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত রামেশ্বরম দ্বীপনগরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে।

পিতা জয়নাল আবেদিন খুব বেশি শিক্ষিত মানুষ ছিলেন না। তবে মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন খুবই বড়ােমাপের। ছােট্টবেলা থেকে পুত্র আবদুলের মনে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তােলার চেষ্টা করেছিলেন।

বারবার তিনি গল্পছলে আবদুলকে বলতেন পরবর্তীকালে তুমি যেন মানুষের মতাে মানুষ হয়ে উঠতে পার।

তিন ভাই আর একবােনের সংসার। জালালউদ্দিন আর শামসুদ্দিনের সঙ্গে আবদুলের ছােটোবেলার দিনগুলি কেটে গিয়েছিল।

পরবর্তীকালে আবদুল স্বীকার করেছেন, বেড়ে ওঠার এই ব্যস্ত প্রহরে দু-ভাইয়ের সান্নিধ্য তাঁকে নানাভাবে উপকৃত করেছিল। তিন ভাই ছিলেন পিতার আদর্শে গড়া সততার প্রতিমূর্তি।

মা আসিয়াম্মা সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। শত দুঃখকষ্ট জ্বালা যন্ত্রণাকে সহ্য করার মতাে সহিষ্ণুতা লুকিয়ে ছিল তাঁর অন্তরে।

মায়ের পরিবারের পূর্বপুরুষরা ব্রিটিশ প্রদত্ত বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। মা কিন্তু তাঁর এই ভাগ্য বিপর্যয়কে হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন।

তিনটি পুত্র এবং একটি কন্যা সন্তানকে কীভাবে বড়াে করা যেতে পারে, তাই ছিল তাঁর ইহজীবনের স্বপ্ন।

ছােটোবেলার খেলার সাথীদের কথাও মনে পড়ে যায় আবদুলের। মেলামেশা করতেন রামনাথ শাস্ত্রী, অরবিন্দ আর শিব প্রকাশনের সঙ্গে, তাঁরা সকলেই ছিলেন সনাতনপন্থী হিন্দু পরিবারের সন্তান।

আর আবদুল গোঁড়া মুসলমান। কিন্তু শৈশবে তাঁদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার ভেদরেখা ছিল না। তখন তাঁরা সকলেই এক সঙ্গে মেলামেশা করতেন।

ভারী সুন্দর ছিল শৈশবের এই অকলঙ্ক দিনগুলি। পৃথিবীর কোনাে সমস্যার বােঝা তখন আমাদের মাথার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় নি।

স্মৃতিচারণের মাধ্যমে বারবার এই হারিয়ে যাওয়া রঙিন দিনগুলির কথা শুনিয়েছেন আবদুল কালাম। তখন সারা বছরের সবচেয়ে বড়াে উৎসব ছিল শ্রীসীতারাম কল্যাণ উৎসব।

গােটা পরিবার এই উৎসবে অংশ নিত। রামসীতার মূর্তি মন্দির থেকে নৌকায় করে তুলে বিবাহমণ্ডপে নিয়ে যাওয়া হত। আবার উৎসব শেষ হলে দুটি মূর্তিকে ফেরত নিয়ে যাওয়া হত মন্দিরে।

কাছেই একটি পুকুর ছিল রামতীর্থ। সেখানে এই দুটি মূর্তিকে শ্রদ্ধাসহকারে অবগাহন করানাে হত।

ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে কত বছর আগে গোঁড়া মুসলমান পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও আবদুল পরম আগ্রহে ওই বাৎসরিক উৎসবে যােগ দিতেন।

‘ দিন কাটতে থাকে। এবার কালামকে বিদ্যালয়ে পড়াশােনা করতে হবে। পিতা ছিলেন বিদ্যানুরাগী, সংস্কৃত সাহিত্যের গল্পকথা আবদুলকে শােনাতেন। মা ঠাকুরমার মুখ থেকে আবদুল রামায়ণ এবং মহাভারতের অনেক কাহিনীও শুনেছিলেন।

এইভাবে তাঁর হৃদয়ে সংস্কৃতির পরম্পরা প্রবাহিত হয়েছিল। তিনি ভর্তি হলেন রামেশ্বরম এলিমেন্টরি স্কুলে। পাশাপাশি বেঞ্চে বসে ক্লাস করেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পুত্রের সঙ্গে।

টিফিনে একই খাবার ভাগ করে খান। এখানে কোথায় যেন একটা অঘটন ঘটে গেল। কালাম তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। মাথায় টুপি পরতেন। এই টুপি দেখে বােঝা যেত তিনি মুসলমান পরিবারের সন্তান।

ক্লাসে সবসময় প্রথম বেঞ্চে বসতেন। একদিন কঠিন কঠোর নীতিবাগীশ শিক্ষকমশাই আবদুলকে প্রথম বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দিলেন। আবদুল এই অপমান অনেক দিন মেনে নিতে পারেননি।

অবশ্য পরবর্তীকালে ওই মাস্টারমশাই তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি আবদুলকে আবার প্রথম বেঞ্চে ডেকে নেন।

রামেশ্বরমে তখন ছােটো ছােটো সামাজিক গােষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল। এক গােষ্ঠীর সদস্যের সঙ্গে অন্য গােষ্ঠীর সদস্যের ক্ষমতার লড়াই চলত। এই ভেদনীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক শিব সুব্রহ্মনিয়াম আয়ার। আয়ার ছিলেন আবদুলের অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক।

কালাম বড়াে হলেন। গ্রামের সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠলেন। খেতে ভালােবাসতেন মাদ্রাজি খাবার, কলা, ভাত আর সম্বর। লঙ্কার সঙ্গে চাটনি।

আবদুলের বাড়ি থেকে রামেশ্বরমের বিখ্যাত শিবমন্দিরটির দূরত্ব খুবই কম। সেই মন্দিরে মাঝে মাঝে যেতেন তিনি।

চোখ বন্ধ করলে ছােটোবেলা খণ্ড খণ্ড ছবি ভেসে ওঠে। রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরােহিত পলিছমন শাস্ত্রীর সঙ্গে পিতার আধ্যাত্মিক আলােচনা বুঝি এখনাে শুনতে পান তিনি।

মুসলমান পিতা এবং হিন্দু পুরােহিত দুধরনের পােশাক পরে একই বিষয় নিয়ে ভাববিনিময় করছেন।

একটু বড়াে হয়ে আবদুল বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলেন-বাবা, প্রার্থনার কি কোনাে আলাদা অর্থ আছে?

বাবা বলেছিলেন শােনাে আবদুল, প্রার্থনার একটা আলাদা মূল্য আছে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আত্মা আছে। প্রার্থনার দ্বারা আত্মার সাথে দেহের যােগসূত্র স্থাপিত হয়।

পরবর্তীকালে কালাম জানিয়েছেন আমার বাবার আধ্যাত্মিক চিন্তা ছিল সহজ সরল গ্রাম্য প্রকৃতির। তিনি বলতেন, এ পৃথিবীর সকলেই ঐশ্বরিক অস্তিত্বের অঙ্গ। সকলের মধ্যে স্বয়ং আল্লাহ বসবাস করছেন।

এবার কালাম এলেন বৃহত্তর শিক্ষা অঙ্গনে। ভর্তি হলেন ওয়াজ হাইস্কুলে। ছােটোবেলার সঙ্গী-সাথীদের সাথে আর তাঁর দেখা হতাে না।

কিশাের কালাম উপলব্ধি করলেন সেই শাস্বত সত্য জীবনে চলার পথে এভাবেই আমরা একলা পথিক হয়ে যাই। এই হাইস্কুলের অনেকের কথাই মনে পড়ে।

ওখানকার শিক্ষক ইয়াদুরাই সলােমনাকে তিনি কখনাে ভুলতে পারবেন না। তাঁকে দেখে কিশাের কালামের মনে হত, তিনি বােধহয় বৈদিক যুগের এক ব্রহ্মচারী। ছাত্রের জীবন অন্বেষণার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।

সলােমন কালামকে কর্মযােগী পুরুষে পরিণত করেছিলেন। এই শিক্ষক কালামকে তিনটি মুল মন্ত্র শিখিয়েছিলেন। জীবনে সফল হতে গেলে তিটি গুণের অধিকারী হতে হবে-ইচ্ছা, বিশ্বাস এবং আশাবাদ।

ইচ্ছা হল গল্প প্রথম প্রহর। যদি মনের মধ্যে ইচ্ছার বীজ তপ্ত না হয় তাহলে আমরা সফলতার গাছ কখনো দেখতে পাব না। দ্বিতীয় প্রহর হল বিশ্বাস।

নিজের কর্তব্যবােধের ওপর অবিচল আস্থা থাকতে হবে। ‘ঈশরের ওপর বিশ্বাস এবং নির্ভরতা রাখতে হবে।

সর্বশেষ প্রহরে আশাবাদ জেগে ওঠে। আশাবাদ না থাকলে অরণ্যচারী মানুষ আজ মহাকাশ বিজয়ী হতে পারত না।

পরবর্তীকালে সলােমন রেভারেন্ড হয়েছিলেন। তিনি কালামকে বলেছিলেন, কোনাে কাজ সার্থকভাবে পূর্ণ করার আগে তােমাকে সেই কাজটির জন্য বাসনা তৈরি করতে হবে।

মনে মনে বারবার বলতে হবে, এই কাজটি অামার দ্বারাই হবে। এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য আমি এই পৃথিবীর বুকে জন্মগ্রহণ করেছি।

পরবর্তীকালে কালাম এই ব্যাপারটি নিজের জীবনে সত্যি বলে প্রমাণ করেছিলেন। সাধারণ পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি জগৎসভায় ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।

১৯৫০ সালে সেন্ট জোসেফ কলেজে ভর্তি হলেন কালাম, ইন্টার মিডিয়েট কোর্সে। এই কলেজে তার চারটি বছর কেটে গিয়েছিল। তারপর ? তারপর উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি।

ছােটোবেলা থেকেই ছিলেন বিজ্ঞানের এক অসাধারণ প্রভাবশালী ছাত্র। স্কুলের পরীক্ষাতে বরাবর কৃতিত্বের সাথে পাশ করেছেন। তাঁর কর্মজীবনটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি ভারতের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন। এখন আমরা যেসব রকেট উৎক্ষেপণ করি, বা আন্তর্দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি রাখতে হবে।

তাঁকেই ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচীর প্রাণপুরুষ বলা হয়ে থাকে। পারমাণবিক বােমা বিস্ফোরণের পরবর্তী সময়ে তিনি একটি সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে বলেছিলেন যে, যদিও আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরমাণু বােমাকে প্রয়ােগ করতে বদ্ধপরিকর, কিন্তু এ বিষয়ে পিছিয়ে থাকলে আমাদের চলবে না, আমাদের একটি নিউক্লিয়ার পাের্টফোলিও তৈরি করে ফেলতে দেশের প্রথম সারির বিজ্ঞানী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করা, রাষ্ট্রপতির পদে দাঁড়ানাে এবং সেই পদে নির্বাচিত হওয়া।

রাষ্ট্রপতি হিসাবে বিভিন্ন বিতর্কমূলক কাজে জড়িয়ে পড়া। নিজেকে রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধ্বে রাখা, এমন অনেক আদর্শ স্থানীয় কাজ করে আজ কালাম।

আমাদের কাছে এক মহান মানুষে পরিণত হয়েছেন। আজও মাঝে মাঝে তিনি বিভিন্ন জায়গাতে ভাষণ দিতে যান। যেখানেই যান, সেখানেই তাঁর শিক্ষকসুলভ দার্শনিকতা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।

সব অর্থে কালামকে আমরা এক ভারতীয় ঋষির সঙ্গে তুলনা করতে পারি। জীবনে তিনি দ্বার পরিগ্রহ করেননি। আজীবন ব্রহ্মচারী তাপসের মতাে জীবন কাটিয়েছেন।

তাই তাঁর প্রতি আমরা আমাদের অন্তরের সশ্রদ্ধ প্রণিপাত নিবেদন করি। ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে আবদুল কালামকে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসাবে আমরা অবশ্যই চিহ্নিত করব।

১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনী—“উইঙ্গস অফ ফায়ার”। এই গ্রন্থের পাতায় পাতায় বিধৃত আছে মানব কল্যাণে উৎসর্গীকৃত প্রাণ এই মহান বিজ্ঞানীর অন্তরের ইচ্ছা।

জীবনের সুদীর্ঘ দুর্গম রাস্তা অতিক্রম করার পর তিনি ২০১৫ সালের ২৭শে জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।

আরও পড়ুন –

চন্দ্রশেখর বেঙ্কটরামন | নোবেলজয়ী, স্বনামধন্য পদার্থবিজ্ঞানী | রামন এফেক্টের আবিস্কারক। C. V. Raman

জগদীশচন্দ্র বসু – বিজ্ঞানসাধক, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী

2 thoughts on “আবদুল কালাম – মিশাইলম্যান, আধুনিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী।”

Leave a Comment