শেখ মুজিবর রহমান
জনগণের শ্রদ্ধায় দেওয়া নাম অনেক সময়ই কোনও মহান মানুষের আসল নামটিকে যেন আড়াল করে রাখে। আমরা তাই সুভাষচন্দ্র বসু বলার থেকে নেতাজী বলতেই যেন বেশি খুশি। স্বামী বিবেকানন্দ নামটিকে ছাপিয়ে স্বামীজী পরিচয়টিই যেন বেশি জড়িয়ে আছে আমাদের মনে, আমাদের ভাবনায়।
ঠিক তেমনই দেশবন্ধু বললেই যেমন চিত্তরঞ্জন দাশকে মনে পড়ে বঙ্গবন্ধু বললেই চোখের সামনে উঠে আসেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রর প্রথম নায়ক এবং জনক মুজিবর রহমান।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নায়ক।
একদিন সুদূর ইমফল থেকে নেতাজীর উদাত্ত বাণী দিল্লি চলাে’ মুক্তিকামী ভারতীয়দের করেছিল ঘরছাড়া, ঠিক তেমনই বাংলাদেশ থেকে দূরে, খণ্ডিত পাকিস্তানের বন্দিশালা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বাংলাদেশের জনগণকে মুজিবর বাণী পাঠালেন। বললেন, ‘আমারে কেউ দাবায়ে রাখতি পারবা না… জয় বাংলা.. সেই বাণী, সেই ধ্বনি মুক্তিকামী বাঙালিদের মনে এনে দিল সংগ্রামের দ্বিগুণ উৎসাহ। অত্যাচারী পাকিস্তানী সেনানায়ক আয়ুব খাঁ আর ইয়াহিয়া খাঁর রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা লাভ করলেন তৎকালীন পুর্ব-পাকিস্তানের জনগণ।
১৯৪৭ সালের পনেরই আগস্টের পবিত্র দিনটি অগণিত ভারতবাসীদের জন্যে বয়ে এনে দিল স্বপ্নের স্বাধীনতা। কিন্তু আনন্দের পাশাপাশি বাজতে থাকল একটা বেদনার সুর। কারণ আমাদের ভারতমাতা হলেন দ্বি-খণ্ডিতা। একই মায়ের দুই পরিচয়হিন্দুস্থান—পাকিস্তান। শুধু কি তাই? সােনার বাংলাও হল দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের নাম হল পশ্চিমবঙ্গ, আর এক ভাগ পূর্ববঙ্গ। যা আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
কিন্তু বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা আনতে গিয়েও হাজার হাজার বাঙালির জীবন হল বিপন্ন। তারা হলেন গৃহহারা। পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিরা পশ্চিম-পাকিস্তানের একনায়ক সরকারের অত্যাচারকে ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন, তাঁরা যে স্বাধীনতা লাভ করেছেন, তা নামেমাত্র। তাঁরা কথা বলতে পারলেও তারা যেন বােবা। কারণ তাদের মাতৃভাষা বাংলার কোনও মর্যাদা দিতে রাজি নন পশ্চিম-পাকিস্তানের রাজা জুলফিকার আলি ভুট্টো উর্দু ভাষাকেই তাঁরা চাপিয়ে দিতে চান পূর্ব-বাংলার বাঙালিদের ওপর। সেদিন প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান, না, না, উর্দু নয়, বাংলা ভাষাই হবে বাঙালিদের রাষ্ট্রভাষা।
শুরু হল পূর্ব বাংলার উপর পাকিস্তানী শােষণ-শাসন। অবাধ্য বাঙালিদের সিধা করতে শুরু হল অত্যাচার। না, তাতে দমন করা গেল না মুজিবর রহমানের নেতৃত্বকে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি পাকিস্তানের এই শােষণ আর শাসনের বিরুদ্ধে তৈরি হলেন মুক্তিযুদ্ধের জন্যে। এক জোট হয়ে তারা মেনে নিল মুজিবর রহমানকে। তৈরি হল সারা পূর্বপাকিস্তান জুড়ে মুক্তিযােদ্ধা-বাহিনী।
মুজিবর রহমান আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ফরিদপুর জেলার গােপালগঞ্জ মহকুমার টাঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ১৭ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। মােটামুটি সচ্ছল পরিবার। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ. পাস করে আইন পড়তে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবনেই তিনি তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে নানা রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তাঁকে সুনজরে দেখতেন না। তাঁরা বললেন, মুচলেকায় সই করে প্রতিজ্ঞা করাে, তুমি রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে পাকিস্তান থেকে পৃথক করার উসকানি দেবে না।
স্বাধীনচেতা ছাত্রনেতা মুজিবর তাতে রাজি হলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশােনায় ইস্তফা দিলেন। ঝাঁপিয়ে পড়লেন পুরােদমে রাজনৈতিক আন্দোলনে। তিনি জনগণকে বােঝালেন, যে জাতির নিজের কোনও সাহিত্য নাই, যে জাতির মাতৃভাষার সরকার মেনে নেয় না, সে সরকারকেও আমরা মানছি না..মানব না…’
মুজিবরের এই উদাত্ত ঘােষণা। সেদিনের সম্মেলনে আসা কয়েকজন বাঙালিই শুধু প্রেরণা পেলেন না। আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ল সারা বাংলাদেশে। কালক্রমে শুরু হল সারা দেশ জুড়ে মুক্তিযুদ্ধ।
অত্যাচারী পাকিস্তানী সরকারের কাছে বাংলা এবং বাঙালিদের নেতা মুজিবর রহমানের অপরাধ তাে কম নয়। তাঁরই এক-একটি কথার ফুলকি বাংলাদেশের প্রতিটি স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে আন্দোলনের দাবানল। সামরিক শাসন শুরু হয়েছে স্তান জুড়ে। প্রধান প্রশাসক জুলফিকার আলি ভুট্টোর দুই পছন্দের সামরিক প্রশাসক আয়ুব খাঁ এবং ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর নির্দেশে মুজিবর রহমানের উপর চালাতে থাকলেন অকথ্য অত্যাচার। কিন্তু ততদিনে যে আরও অনেক মুজিবর তিনি তৈরি করে নিয়েছেন সংগ্রামীদের মধ্যে। তাই সেই দাবানল নেভানাের জন্যে নির্বিচারে চলল গণহত্যা। পাকিস্তানী জঙ্গিদের হাতে নিহত পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার শিক্ষিত বাঙালি সমেত অসংখ্য শিশু-নারী-পুরুষ। এই অসভ্য অত্যাচার পৃথিবীর ইতিহাসে এক নির্মম দৃষ্টান্ত।
|মুজিবর রহমান বন্দি হলেন। কিন্তু বন্দি হয়ে থাকল না বাঙালিদের স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টা। আন্দোলন চলতেই থাকে। সেই সময় প্রায় এক কোটি মানুষ পূর্ব-পাকিস্তান ছেড়ে পালিয়ে এলেন ভারতবর্ষে। তখন স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তিনি একই সঙ্গে এক কোটি উদ্বাস্তু মানুষের সমস্যা এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের সমস্যা মেটাতে মুজিবর রহমানের আন্দোলনে যুক্ত করলেন তাঁর সামরিক শক্তি। মিত্র বাহিনী’ হিসাবে সেদিন ভারতীয় জওয়ানেরা নিজেদের সমস্যা হিসাবে সেই আন্দোলনকে গ্রহণ করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিলেন ওপার বাংলার দিকে। আর ওদিকে তখনও পাকিস্তানী জেলে বন্দি বাংলার আর এক ব্যাঘ্র সন্তান হুঙ্কার ছেড়ে চলেছেন। গান্ধীজীর ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ বাণীর মত বন্দিশালা থেকে বলেছেন, “তােমরা এগিয়ে যাও…আমাদের আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলন…স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র আমাদের পেতেই হবে…।
অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে টানা চোদ্দ দিনের যুদ্ধের পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে পরাজয় স্বীকার করতে হল। পূর্ব-পাকিস্তান তার পাকিস্তানী নাম পালটে পরিচিত হল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে।
মুক্তি পেলেন মুজিবর রহমান। সরাসরি তাঁর স্বপ্নে গড়া বাংলাদেশের মাটিতে ফিরতে পেলেন না। পাকিস্তানী বন্দিশালা থেকে তাঁকে পাঠানাে হল লন্ডনে। লন্ডন থেকে ভারতবর্ষ হয়ে মুজিবর রহমান ফিরলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। তিনি হলেন রাষ্ট্রপ্রধান। অযুত মানুষের রক্ত ঝরানাে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশের মানুষেরা গেয়ে উঠলেন তাঁদের পবিত্র জাতীয় সঙ্গীত ও
‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি।…’
কিন্তু সােনার বাংলা, স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রধান কারিগর বেশিদিন থাকতে পেলেন না তাঁর দেশের নীল আকাশের নীচে। নিঃশ্বাস নিতে পেলেন না স্বাধীন বাংলা বাতাসে। স্বাধীনতা লাভের মাত্র চার বছর পরে ১৯৭৫ সালের ১১ই আগস্টের মাঝরাতে নিজের দেশের আততীয়াদের হাতে তাঁকে প্রাণ হারাতে হয়। কিন্তু তাঁর অমর আত্মা বেঁচে আছে, আগামীতেও থাকবে বাংলাদেশের জনগণের মনে— ভাবনায়—স্বপ্ন।
আরও পড়ুন –
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ – আইনবিশারদ, ব্যারিস্টার, দেশপ্রেমিক। Chittaranjan Das | Indian lawyer