সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
পৃথিবীতে হয়তাে এমন লেখক আর একজনও নেই। যার অগ্নিবর্ষী কলমে সৃষ্ট একটি মহামন্ত্র জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর রচিত উপন্যাস হল “আনন্দ মঠ”। সেই “আনন্দ মঠ” উপন্যাসে তিনি “বন্দেমাতরম্” মন্ত্রটি অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তীকালে এই উপন্যাসটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রাণের মন্ত্রে পরিণত হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বলা হয়। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন। এবং তিনি নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি মেদিনীপুরে ডেপুটি কলেক্টর পদে চাকরি করতেন।
যাদবচন্দ্রের তৃতীয় পুত্র হলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর প্রথম পুত্রের নাম হল শ্যামাচরণ এবং দ্বিতীয় পুত্রের নাম হল সঞ্জীবচন্দ্র। সঞ্জীবচন্দ্র একসময় সাহিত্যিক হিসাবে যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেছিলেন।
যাদবচন্দ্রের চতুর্থ পুত্র অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্রের ছােটো ভাইয়ের নাম পূর্ণচন্দ্র। পূর্ণচন্দ্র পরবর্তীকালে বঙ্কিম জীবনের অনেক অজ্ঞাত তথ্য জীবনীকারদের কাছে তুলে ধরেন। তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে রচিত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রামাণ্য জীবনী গ্রন্থ।
কাঁঠালপাড়াতেই বঙ্কিমচন্দ্র দু’বছর বয়স পর্যন্ত থাকতেন। তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয় ওই নৈহাটির কাঁঠালপাড়াতেই। যখন বঙ্কিমচন্দ্রের পাঁচ বছর বয়স তখন কুলপুরােহিত বিশ্বম্বর ভট্টাচার্যের কাছ হাতে খড়ি হয়েছিল।
বঙ্কিমচন্দ্র ছােটোবেলা থেকেই তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়েছেন। শােনা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র নাকি একদিনেই বাংলা বর্ণমালা নিজের আয়ত্তে করে নিয়েছিলেন।
পিতা যাদবচন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন যে, বঙ্কিমের মধ্যে এক অসাধারণ প্রতিভা লুকিয়ে আছে। তিনি তাই বঙ্কিমের প্রতি অতিরিক্ত যত্নবান হয়ে ওঠেন। শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে যাদবচন্দ্রের সতর্ক দৃষ্টি ছিল।
বঙ্কিম ১৮৪৪ সালে মেদিনীপুর এলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র দু’বছর। তখন তাঁর পিতা মেদিনীপুরেই কাজ করতেন। তাই বঙ্কিমকে মেদিনীপুর জেলার মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করা হল।
বঙ্কিমের স্বভাব অত্যন্ত নম্র। তাই অল্প দিনের মধ্যেই শিক্ষকদের প্রিয় হয়ে ওঠেন বঙ্কিম। কলমের পাঠেও তিনি ছিলেন সকলের আগে। তাঁকে সহপাঠীরা বিশেষভাবে সমীহ করে তুলতেন।
১৮৪৯ সালে এগারাে বছর বয়সে বঙ্কিম আবার নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন। সেই বছরে ফেব্রুয়ারি মাসে নারায়ণপুর গ্রামের একটি বালিকার সঙ্গে বিয়ে হয় বঙ্কিমের। বালিকার বয়স পাঁচ বছর এবং বঙ্কিমের বয়স তখন এগারাে বছর।
১৮৫৩ সালে বঙ্কিমের জীবনে একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটেছিল। বঙ্কিম সংবাদ প্রভাকর নামক একটি পত্রিকায় কবিতা প্রতিযােগিতায় অংশ গ্রহণ করলেন। তখন তাঁর বয়স পনেরাে বছর। সেই প্রতিযােগিতায় বঙ্কিম সেবার কুড়ি টাকা পারিতােষিক পেয়েছিলেন।
তাঁর কবিতাটির নাম হল কামিনীর উক্তি— তােমাকে লাে ষড়ঝুঁত—এই কবিতাটি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে পাঠক পাঠিকারা নবীন কবিকে সাদরে বরণ করেন।
বঙ্কিম এবার এলেন হুগলী কলেজে। হুগলী কলেজে ঈশ্বর গুপ্তের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন। কবিবর, সংবাদ প্রভাকরে ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত গদ্য ও পদ্য রচনা প্রকাশিত হতে শুরু করে। তিনি সংবাদ সাধুরঞ্জনের নিয়মিতভাবে লিখতে থাকেন।
হুগলী কলেজে তখন সিনিয়ার বৃত্তি পরীক্ষা শুরু হয়। আর বঙ্কিম সব বিষয়ে কৃতিত্ব অর্জন করে। সব বিষয়ে কৃতিত্ব অর্জন করার জন্য বঙ্কিম চন্দ্র দু’বছরের জন্য মাসিক কুড়ি টাকা বৃত্তি পেয়েছিলেন। তিনি ১৮৫৬ সালে হুগলী কলেজে ভর্তি হন। বঙ্কিম আইন বিভাগ নিয়ে পড়াশােনা শুরু করেন। এই বন্দরে তাঁর ললিতা পুরাকালীক গল্প তথা মানস প্রকৃতি কবিতা প্রকাশিত হতে শুরু করে।
ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন বঙ্কিমের সাহিত্যিক গুরু। পরবর্তীকালে ঈশ্বর গুপ্তের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন বঙ্কিম মুক্ত কণ্ঠে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৭ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করা হয়।
বঙ্কিম প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন। তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এই থেকে প্রমাণিত হয় যে বঙ্কিম ছাত্র হিসেবে কতখানি কৃতী ছিলেন।
১৮৫৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতাে বি. এ. পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। সেবার মােট দশজন ছাত্র পরীক্ষা দিয়েছিলেন। মাত্র দু’জন উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, বঙ্কিম এবং যদুনাথ বসু।
আইন পরীক্ষা দেবার জন্য এবার বঙ্কিম প্রস্তুত হতে থাকেন। কিন্তু পরীক্ষার আগেই বঙ্কিমকে নিযুক্ত করা হয় যশাের জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেকটর হিসাবে।
বঙ্কিম এলেন যশাের জেলাতে। ১৮৬৯ সালে তিনি চাকরিরত অবস্থায় আইন পরীক্ষা দিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। এই আইন পরীক্ষায় বঙ্কিম প্রথম বিভাগে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন।
বঙ্কিম সরকারি পদে বহাল ছিলেন দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে। তিনি এই উল্লেখযােগ্য কর্মজীবনের অবসানে অবসর গ্রহণ করেন ১৮৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
বঙ্কিমচন্দ্রের স্ত্রীর মৃত্যু হয় ১৮৫৯ সালে। ঠিক তার পরের বছর বঙ্কিম আবার বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় পত্নীর নাম হল রাজলক্ষ্মী দেবী।
রাজলক্ষ্মী দেবীর প্রভাব বঙ্কিমের জীবনে অপরিসীম। এনার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বঙ্কিম মন্তব্য করেছেন—আমার জীবন অবিশ্রান্ত সংগ্রামের জীবন। একজনের প্রভাব আমার এবং আমার পরিবারের বড় বেশী রকমের । আমার জীবনে লিখতে হলে তাঁরও লিখতে হয়। তিনি না থাকলে বলতে পারি না আমি কি হতাম।
বঙ্কিম অবিভক্ত বঙ্গদেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়েছিলেন হাকিম হিসাবে। সুযােগ পেয়েছিলেন তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশার। তিনি একটির পর
> একটি উপন্যাস লিখতে থাকেন এই সুযােগকে কাজে লাগিয়ে। বঙ্কিম মােট চোদ্দটি উপন্যাস লিখেছিলেন। বাংলা উপন্যাসের জয়যাত্রা সূচিত হয় বঙ্কিমের হাত ধরে। শুধু উপন্যাস নয়, বঙ্কিম বেশ কয়েকটি মননশীল প্রবন্ধ গ্রন্থ লিখে গেছেন। কৃষ্ণচরিত্রের মতাে একটি অসামান্য বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ গ্রন্থ লিখেছেন। বঙ্কিম হাস্যরস জাতীয় রচনা করতেন। বঙ্কিমের এই কৃতিত্বের কথা আমরা কখনাে ভুলবাে না।
বঙ্কিম চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন ১৮৯১ সালে। এবার তিনি কলকাতাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ১৮৯৪ সালের ৬ এপ্রিল সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।