শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় | Sarat Chandra Chattopadhyay | কথাশিল্পী

অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

আজও যিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে কথা শিল্পী, আজও উপন্যাসের সঙ্গে পড়া হয়ে থাকে যার লেখা গল্প উপন্যাস, তিনি হলেন অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আমাদের নিপীড়িত বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ দুঃখের নকশিকাঁথা তিনি বুনেছিলেন। তাকে অমর কথাশিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠাতা দিয়েছে। কারণ দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হতে হতে, অপমানের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে তিনি প্রচুর অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তাই তাঁকে অমর কথাশিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠাতা দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার লেখা গল্প, উপন্যাস। আজও শরৎচন্দ্রের সাহিত্য হল চলচ্চিত্রের অন্যতম মাধ্যম।

নারী জাতির আপন মনের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে শরৎসাহিত্যে। এটি সব । থেকে বড় গুণ শরৎ সাহিত্যের। আমাদের সমাজে কখনই রমণীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার পায়নি। আজও তাদের দমিয়ে রাখা হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। এইসব নিপীড়িত নারীদের সপক্ষে সওয়াল করেছেন শরৎচন্দ্র। জেহাদ ঘােষণা করেছেন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে।

শরৎচন্দ্রের জীবন ছিল ঘটনা বহুল। শরৎচন্দ্রের জীবনী পাঠ না করলে আমরা বুঝতে পারতাম না একজন মানুষের জীবনে যে এত বিচিত্র সুন্দর অভিজ্ঞতা হতে পারে। তাকে অল্প বয়সে ভাগ্যের বিড়ম্বনায় নানা জায়গায় যেতে হয় জীবিকার সন্ধানে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসতে হয়েছে।

শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল বাংলা ১২৮৩ বঙ্গাব্দের ৩১ শে ভাদ্র। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন হুগলী জেলার দেবানন্দপুরে।

শরৎচন্দ্রের পিতার নাম হল মতিলাল চট্টোপাধ্যায়। তিনি এক উদাসী প্রকৃতির মানুষ। তাকে স্পর্শ করতে পারেনি সাংসারিক জীবনের কাঠিন্য। তিনি আপন মনের খেয়ালে রচনা করতেন গল্প, উপন্যাস, কবিতা প্রভৃতি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনােটাই শেষ করতে পারেননি। বাউন্ডুলে বলেত যা বােঝায়, সেই শ্রেণীভুক্ত ছিলেন মতিলাল।

এর ফলে এই পরিবারের নিত্য সঙ্গী হয়ে ওঠে দরিদ্রতা। নিদারুণ দুঃখযন্ত্রণার মধ্য দিয়ে শরৎচন্দ্রের ছােটোবেলা কেটে গেছে। শরৎচন্দ্র কখনাে পাননি শিশুদের আনন্দ বলতে যা বােঝায় তার স্বাদ। শরৎচন্দ্রের মামার বাড়ি হল ভাগলপুর। সেখানে কিশাের বয়সে শরৎচন্দ্র চলে আসেন এবং সেখানে তিনি বেপরােয়া আনন্দ, অভিসারে মেতে রইলেন। মাঝে মধ্যে চুপটি করে বসে থাকতেন গঙ্গার ধারে। আর গালে হাত দিয়ে কিসব যেন ভাবতেন।

শরৎচন্দ্রের ছােটোবেলায় একবার মাথায় ফোঁড়া হয়েছিল। তখন তাঁর সব চুল উঠে গিয়েছিল। চুল উঠে যাওয়ার জন্য শরৎচন্দ্রের বন্ধুরা তাকে ন্যাড়া বলে খেপাতেন।

পরীক্ষায় তিনি পাশ করলেন এবং তারকেশ্বর গেলেন তার মায়ের কথায়। প্রমাণ করলেন মাথা মুড়িয়ে ন্যাড়া নামের স্বার্থকতা।

শরৎচন্দ্র ছিলেন বাড়ির প্রথম ছেলে। মা আর ঠাকুমার অত্যন্ত আদুরে ছিল। শরৎচন্দ্রের জেদি এবং একগুয়ে স্বভাব ছিল। তিনি ভালােবাসতেন হৈ হৈ করতে। প্রতিবেশীদের কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা ছিল দেবানন্দপুরে ন্যাড়া এবং তার দলবল। ন্যাড়ার পড়াশুনায় খুব একটা মন ছিল না। তিনি মেতে উঠতেন নিত্য নতুন খেলার সন্ধানে। কিন্তু কিছুতাে একটা করতে হবে। তাই তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হল পণ্ডিতের পাঠশালায়।

ন্যাড়া পাঠশালা থেকে মাঝে মধ্যেই পালাতেন। আর তার পর বন্ধুদের নিয়ে হাজির হতেন সরস্বতী নদীর তীরে। পথে ঘাটে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। হরিণের পায়ে সুতাে বেঁধে খেলতেন।

খুবই সাহসী ছিল ন্যাড়া। তাই আমবাগানে শাকচুন্নির ভয় পেতেন না নিরালা দুপুরে। সকলকে অবাক করে রাতের অন্ধকারে একা একা চলে যেতেন বাঁশ বাগানে।

তিনি ফড়িং খুঁজতে ভালােবাসতেন। নানা রকমের ফড়িং পুষে রাখতেন একটি কাঠের বাকসে। ভালােবাসতেন মাছ ধরতে। ন্যাড়াকে এ-গ্রাম থেকে সে গ্রামে ছুটে বেড়াতে হতাে। শুধুমাত্র ফড়িং সংগ্রহ করার জন্য।

মাছ ধরার ছিপ পাওয়ার জন্য তিনি ঠাকুমার কাছে বায়না ধরলেন। গ্রামের দুরন্ত লাঠিয়াল নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে যাবেন ছিপ কিনতে বসন্তপুরের হাটে। নারায়ণ চন্দ্রের সঙ্গে পয়সা নিয়ে ন্যাড়া চললেন। ঠ্যাঙরেদের পাল্লায় পড়লেন বসন্তপুর হাট থেকে ফেরার সময়। সে রাত্রে ন্যাড়া প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন শুধুমাত্র নারায়ণচন্দ্রের লাঠির জোরে।

ন্যাড়াকে মাঝে মধ্যেই দশ ঘা, বিশ ঘা খেতে হতাে পিয়ারী পণ্ডিতের পাঠশালায়। নানা নালিশ জমা হতাে ন্যাড়ার বিরুদ্ধে। যেমন ফলচুরি, ফুলচুরি, সহপাঠীদের বুদু করা। এইসব দুষ্টমি করা সত্ত্বেও ন্যাড়া ভালাে নম্বর পেয়েছিলেন পরীক্ষাতে। শরৎচন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে পিয়ারী পণ্ডিত অবাক হয়ে গেলেন।

শরৎচন্দ্রের ভাগলপুরে যে মামারা থাকতাে, তারা যথেষ্ট বড়লােক। তাদের মস্ত বড় বাড়ি ছিল, সেখানে গিয়ে মন বসাতে পারেনি ন্যাড়া। সেখানে দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হলাে শরৎচন্দ্রকে (ন্যাড়াকে)। তখন ন্যাড়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। নতুন স্কুলে ভর্তি হবার পরও এতটুকু দুষ্টুমি কমেনি শরৎচন্দ্রের। স্কুলের পণ্ডিত মশাই ছিল অক্ষয়বাবু। ন্যাড়া তাঁর চোখে ধুলাে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতেন।

১৮৮৭ সালে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় শরৎচন্দ্র। তারপর শরৎচন্দ্র সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হলেন দেবনারায়ণ জুবিলি স্কুলে। শরৎচন্দ্রের তখন থেকেই বই পড়ার শখ ছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি বই পড়তেন। তিনি পড়তেন হরিদাসীর গুপ্ত কথা আর বটতলার বই।

একদিন বাংলা কথা সাহিত্যে অপরাজেয় কথা শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেন সেদিনের সেই ন্যাড়া বালক শরৎচন্দ্র। পুরস্কার প্রতিযােগিতায় একটি গল্প লিখলেন ছদ্মনাম মন্দির নামে। তারজন্য তিনি প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন। এবার তার সােনার লেখনী থেকে এল অসংখ্য পালনীয় উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, যেমন শ্রীকান্ত চার খণ্ড, বিন্দুর ছেলে, দেবদাস, পথের দাবী, গৃহদাহ, চরিত্রহীন, বড়দিদি, মেজদিদি, মহেশ, অভাগীর স্বর্গ ইত্যাদি। >

১৯৩৮ সালের ১৫ই জানুয়ারি তারিখে বাংলা ভাষার এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথা শিল্পীর মৃত্যু হয়।

Leave a Comment