চৈতন্যদেব-বৈষ্ণব ধর্মের প্রবক্তা।

চৈতন্যদেব

ভারতবর্ষের বুকে একদা ভক্তিবাদী অধ্যাত্মপন্থী আন্দোলনের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। এই ভক্তিবাদে যারা বিশ্বাস করেন তাঁরা ধর্মীয় গোঁড়ামিকে মানতে চান না। তাঁরা কখনােই বলেন না যে, একটি ধর্মের মধ্যে জন্মগত বা বর্ণ-গত কারণে পার্থক্য থাকবে। আমরা এই পৃথিবীর সন্তান, সকলেই ঈশ্বরের অনুগ্রহে, মনুষ্য জন্মলাভ করেছি। আমাদের জীবনের একটি মাত্র উদ্দেশ্য হল ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশ করা। একসময় অবিভক্ত বঙ্গদেশে ভক্তিধর্মের জোয়ার এনেছিলেন শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব। তাঁর জীবনে বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেছে, আজও তিনি বাঙালির মনন ও মানসিকতাকে আচ্ছন্ন করে আছেন। চৈতন্যপন্থীরা আজও নাম সংকীর্তনের মাধ্যমে সমাজের বুকে মেতে ওঠেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এই সমাজে কেউ উঁচু বা নীচু নয় সকলেই এক গােষ্ঠী ভুক্ত। কিন্তু কিছু মানুষ নিজেদের উচ্চ বংশগত বলে দাবি করেন। তাঁরা তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের ওপর অকথ্য শারীরিক, মানসিক, আর্থিক এবং সাংস্কৃতিক অত্যাচার চালিয়ে যান। সমাজের সমস্ত সুযােগগুলিকে নিজেদের কুক্ষিগত করতে চান। এইসব স্বার্থপর মানুষের বিরুদ্ধে চৈতন্যদেব একসময় এই মহান আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে তাঁর আন্দোলনের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা আমরা হয়তাে উপলব্ধি করতে পারব না। কিন্তু যেদিন তিনি এই আন্দোলন শুরু করেন সেদিন বাংলাদেশের অবস্থা খুব একটা ভালাে ছিল না।

বাংলাদেশের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নানা কুসংস্কারের প্রবেশ ঘটেছিল। তিনি একা সেই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। অনেক দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রনার পর শেষ পর্যন্ত তিনি এই অসম অভিযানে জয়যুক্ত হয়েছিলেন। আজ থেকে পাঁচশাে বছরেরও বেশি আগে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব পৃথিবীর আলাে দেখেন। তিনি জন্মেছিলেন ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে অর্থাৎ দোল যাত্রার দিন। তাঁর জন্ম হয়েছিল নদীয়ার অন্তর্গত নবদ্বীপ শহরে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর পিতার নাম পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র এবং মায়ের নাম শচীদেবী। ছােটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন খুব দুষ্ট প্রকৃতির। তাঁর ছােটবেলার নাম ছিল নিমাই। তাঁর আর একটি নাম ছিল বিশ্বম্ভর। তাঁর সােনার বরণ রূপ দেখে পাড়ার লােকেরা আদর করে তাঁকে শ্রীগৌরাঙ্গ নামে ডাকতেন। ভক্তজনের কাছে তিনি আরও কতগুলি নামে পরিচিত, যেমন নবদ্বীপ চন্দ্র, মহাপ্রভু এবং গৌর সুন্দর।

একেবারে ছােটবেলার দিনগুলি কেটে গিয়েছিল হৈ হৈ করে। বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে ভালােবাসতেন তিনি। পাড়াপ্রতিবেশীর বাগানে গিয়ে উৎপাত করতেন। নালিশের পাহাড় জমত। তাতেও ভ্রক্ষেপ ছিল , সেদিনের ছােট্ট বালক গৌরাঙ্গ বা নিমাইয়ের।

দশ-এগারাে বছর বয়সে নিমাইয়ের পিতার মৃত্যু হয়, বিধবা মা তাকে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে পড়তে পাঠালেন। যজমানি টোলে পড়ানাে—এর বাইরে অন্য কোনাে পেশার কথা ওই বংশের কেউ কখনাে ভাবতেও পারেননি। নিমাইয়ের ছিল অসাধারণ মেধা। সারাদিন দুষ্টুমি করলে কী হবে, পাঠ্যবইয়ের সব পড়া অতি দ্রুত মুখস্থ করতে পারতেন। তিনি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে অসামান্য পাণ্ডিত্য অর্জন করলেন। এবার নিজেই একটা টোল খুলে বসলেন। সেই টোলে হলেন অধ্যাপক। তাঁর পাণ্ডিত্যের গুনে ছাত্ররা দলে দলে সেই টোলে এসে ভিড় করতে লাগল। কিশাের বয়সেই তিনি কাশ্মীরের বিখ্যাত পণ্ডিত কেশব মিশ্রকে শাস্ত্রীয় তর্কে পরাস্ত করেন। তাঁর পাণ্ডিত্যের সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

নিমাইয়ের বড়াে ভাই বিশ্বরূপ সংসার ত্যাগ করে চলে গেছেন। তাই সংসারের সমস্ত দায়দায়িত্ব এখন ছােটভাই নিমাইয়ের ওপর বর্তেছে। নিমাইয়ের মধ্যেও এক ধরনের উদাসীনতা আছে। তাঁর মা সেটা লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি ভাবলেন ছেলের বিয়ে দিলে তবে ছেলে সংসারী হবে। না হলে হয়তাে দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কোনােদিন অরণ্যচারী সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। দুই পুত্রকে হারিয়ে তিনি বাঁচবেন কী করে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে তিনি পরমা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে নিমাইয়ের বিয়ে দিলেন।

এরপর নিমাই এলেন গয়াতে। পিতার পিণ্ডদান করতে। গয়াতে পৌছানাের পর তাঁর চরিত্রে একটি স্মরণযােগ্য পরিবর্তন ঘটে গেল। যে নিমাইকে আমরা চঞ্চল ছটফটে এক বালক হিসাবে দেখেছিলাম, আজ তিনি এক স্থিতধী পণ্ডিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে পাণ্ডিত্যের কোনাে অভিমান নেই, নেই শাস্ত্রীয় তর্কের বিলাস। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি বুঝি আপনভােলা এক ‘ মহাপুরুষ। এক মহাসাধক যিনি মুখে মুখে নামগান প্রচার করতে চান। তাঁর মুখ দিয়ে শুধু দুটি শব্দ মাত্র নির্গত হচ্ছে—হা কৃষ্ণ, তিনি সত্যি সত্যি এক কৃষ্ণ বিরহী মানুষে পরিণত হয়েছেন। দুটি চোখ দিয়ে সর্বদা অশ্রুধারা নির্গত হচ্ছে। নবদ্বীপে ফিরে আসর পর তাকে দেখে সকলে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

গয়াতে এমনকি ঘটা ঘটেছিল, যা নিমাইকে এভাবে পরিবর্তিত করে? নিমাই সেখানে প্রথানুসারে ফর্মু নদীতে স্নান করেছিলেন। তারপর শুদ্ধ চিত্তে বিষ্ণু মন্দিরে প্রবেশ করেন। দলে দলে তীর্থযাত্রীরা বিষ্ণু মন্দিরে আসছেন। দেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করেছেন, চারিদিকে কেমন একটা পবিত্র ভাব। এই দৃশ্য দেখে নিমাই কেমন যেন হয়ে গেলেন। তাঁর মধ্যে এক ভাবান্তর উপস্থিত হল। তখনই হঠাৎ থরথর করে তাঁর সমস্ত তনুবাহার কেঁপে ওঠে। দুচোখ দিয়ে অশ্রু নির্গত হয়। ভক্তিরসের আবেগে তিনি একেবারে আত্মহারা হয়ে যান। আধ্যাত্মিকতার ভাবাবেশে হয়ে যান অচেতন। এই সময় এক বৈষ্ণব তাঁকে হঠাৎ ধরে ফেলেছিলেন। তিনি হয়তাে বুঝতে পেরেছিলেন যে, নিমাইয়ের মধ্যে মানসিক প্রক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে। তাঁর বাহ্যজ্ঞানহীন দেহটাকে বাইরে নিয়ে আসা হল। যে ভদ্রলােক এইভাবে নিমাইকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, তিনি হলেন পরম ভগবত ঈশ্বরপুরী।

কিছুক্ষণ বাদে নিমাইয়ের এই অচেতন অবস্থা কেটে গেল। তিনি আবার বাস্তব পৃথিবীতে ফিরে এলেন, তাঁর সাহায্যকারীকে বললেন, কীভাবে আমি মুক্তিলাভের মন্ত্রলাভ করব? আপনি কি অনুগ্রহ করে আপনার চরণে আমাকে স্থান দেবেন?

তাঁর এই কথা শুনে ঈশ্বরপুরী অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ঈশ্বরপুরী বুঝতে পারলেন এই মানুষটির মনের ভেতর এক ধরনের বৈরাগ্যের জন্ম হয়েছে। তিনি নিমাইকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দিলেন। সেদিনের নিমাই পণ্ডিতই পরিণত হলেন শ্রী শ্রী চৈতন্য বা শ্রী কৃষ্ণ শ্রী চৈতন্যদেব-এ।

ভগবান এবং বাস্তব জগৎ সম্পর্কে নিস্পৃহ হয়ে গেছেন তিনি। তার এই ভাবান্তর দেখে স্ত্রী খুবই দুঃখ পেয়েছেন। কিন্তু কার কাছে নালিশ করতে যাবেন। আর নিমাই সবসময় ভগবানের ধ্যানে নিমগ্ন থাকেন। বিভিন্ন গ্রাম থেকে বৈষ্ণব ভক্তরা এসে তাঁর সাথে মিলিত হচ্ছেন। শ্রীবাসের অঙ্গনে কীর্তন চলতে থাকে। আর নিমাই ভাবাবেশে নৃত্য করতে থাকেন।

মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে নিমাই সবকিছু ত্যাগ করে হলেন সন্ন্যাসী, মহাসন্ন্যাসী। ইতিমধ্যে তাঁর প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে, দ্বিতীয় স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া এলেও তাঁর পথ আটকাতে পারেননি। নিমাই বুঝতে পেরেছিলেন অনিত্য এই জগৎসংসারে সংসাররূপী মায়ার বন্ধনে নিজেকে জড়ানাে শেষ পর্যন্ত শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তখন থেকেই নিমাইয়ের নামকরণ করা হয় শ্রীচৈতন্যদেব।

গয়া থেকে শ্রীচৈতন্যদেব পুরীতে গেলেন। সেখান থেকে নীলাচলে। নীলাচল থেকে বৃন্দাবন। বৃন্দাবন যাবার পথে মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য নবদ্বীপে গিয়েছিলেন। আসলে সন্ন্যাস নেবার পরও তিনি কিন্তু মাকে ভুলতে পারেননি। এটি তাঁর মাতৃ আরাধনার সবথেকে বড় দিক চিহ্ন।

দেখা হয়ে গেল স্ত্রীর সঙ্গে। স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া স্বামীকে প্রণাম করলে তিনি বলেছিলেন—তুমি কে?

এই প্রশ্ন শুনে বিষ্ণুপ্রিয়া অবাক হয়ে যান। তিনি বলেন—তুমি কি আমায় চিনতে পারছাে না?

চৈতন্যদেব একটু হেসে বলেছিলেন—তুমি এতদিন ছিলে বিষ্ণুপ্রিয়া, আজ থেকে কৃষ্ণপ্রিয়া হও। এই কটি কথা বলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীর চোখের আড়ালে চলে গেলেন। আসলে তিনি হয়তাে এই সান্নিধ্যে বেশিক্ষণ থাকতে চাইছিলেন না। কারণ তিনি জানেন যদি একবার সংসার জীবনের কথা মনে পড়ে যায় তাহলে তিনি হয়তাে নিজেকে আটকে রাখতে পারবেন না।

এই মহান কৃষ্ণ সাধকের জীবনের বেশির ভাগ সময় নীলাচলে অতিবাহিত হয়। অবশ্য এর মধ্যে তিনি দাক্ষিণাত্যে পরিভ্রমণ করেছিলেন। নীলাচলে গিয়ে অনিমেষ নয়নে জগন্নাথদেবের দারু মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তখন ভাবাবেগ আবিষ্ট হয়ে যেতেন। নীলাচলে তাঁর এক ভক্তমণ্ডলী গড়ে ওঠে, তবে তিনি মায়ের সাথে নিয়মিত যােগাযােগ রেখে চলতেন। মাকে তিনি বিশ্বজননী হিসাবে পুজো করেছিলেন।

১৫৫৩ সালের আষাঢ় মাসে চৈতন্যদেব হঠাৎ চিরকালের জন্য অন্তর্হিত হয়ে যান। তাঁর মৃত্যু কীভাবে হয়েছে তা নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে। অনেকে বলে থাকেন সমুদ্রের নীল জলে তিনি নীল মাধবকে দেখে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। অনেকে আবার বলে থাকেন, না, গুপ্ত ঘাতকের হায্যে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।

তাঁর প্রচলিত ধর্মমত গ্রহণ করে অনেক মানুষ তাঁর অনুগামী হয়েছিলেন। এতে স্থানীয় পাণ্ডা এবং পণ্ডিতদের খুবই অসুবিধা হয়।

আজ থেকে পাঁচশাে বছর আগে চৈতন্যদেব সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলে গেছেন। তিনি বলেছেন—ঈশ্বরের আরাধনায় সকলের সমান অধিকার। প্রাণের ভক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে ডাকলে আমরা তাঁকে উপলব্ধি করতে পারি। ভক্তিতেই মুক্তি লুকিয়ে আছে। তিনি যে মহানাম প্রচার করে গেছেন আজও তা সংকীর্তণের মাধ্যমে হাজার মানুষের কাছে পৌছে যায়

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

আরও পড়ুন –

গুরু নানক – বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক , শিখ ধর্মের প্রবর্তক।

গুরু নানক – বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক , শিখ ধর্মের প্রবর্তক।

গৌতম বুদ্ধ – বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা , মুক্তির দিশারী।

2 thoughts on “চৈতন্যদেব-বৈষ্ণব ধর্মের প্রবক্তা।”

Leave a Comment