জননী মাদার টেরেসা
মাদার টেরেসা—এই শব্দটি উচ্চারণ হবার সঙ্গে সঙ্গে যে ভক্তিমতি মহিলার মুখখানি আমাদের মণিকোঠায় ভেসে ওঠে তিনি হলেন সাধারণ শাড়ি পরিহিতা। এক বিদেশিনী ভদ্রমহিলা। অজস্র মানুষের মুক্তির পথ করে দেবার জন্য অশেষ পরিশ্রম করেছেন।
মাদার টেরেসার জন্ম হয়েছিল তদানীন্তন যুগােশ্লোভিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের ছােট্ট গ্রাম স্কোপজেতে। সেখানকার এই আলবেনির রােমান ক্যাথলিক কৃষক পরিবারে ১৯১১ সালের ২৭ শে আগষ্ট মাদার পৃথিবীর আলাে দেখেন। তাঁর পিতার নাম নিকোলাস বােজাকস্কি। তিনি পেশায় ছিলেন মুদি। মেয়ের নামকরণ করেছিলেন অ্যাগনেস গােনপ্রহা।
এই পরিবারটি ছিল অত্যন্ত দরিদ্র। এই পরিবারের সদস্যরা হয়তাে কোনাে দিন ভাবতে পারেননি যে একদিন ছােট্ট মেয়ে অ্যাগনেস মাদার টেরেসা নামে বিশ্বজননী হয়ে উঠবেন।
ছােটোবেলা থেকেই অ্যাগনেস ঈশ্বরে ভক্তি রাখতেন। মাঝে মধ্যে চোখ বন্ধ করে দাঁড়াতেন করুণাময় মানব ত্রাতা যিশু এবং মাতা মেরীর ছবির সামনে। বিশ্ববাসীর মঙ্গলের জন্য নীরবে প্রার্থনা করতেন। ছােটোবেলা থেকেই অ্যাগনেস বুঝতে পেরেছিলেন নীরব প্রার্থনার মধ্য দিয়ে আমাদের শরীরে এক ধরণের শক্তির সঞ্চরণ ঘটে যায়। পরবর্তীকালেও মাদার তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার অন্যতম বাহক হিসাবে প্রার্থনাকেই বেছে নিয়েছিলেন।
অ্যাগনেসরা ছিলেন দু’বােন এক ভাই। অ্যাগনেসের একটি পা ছিল কিছুটা ছােটো। শারীরিক এই বিকৃতির জন্য অনেক সময় তাঁকে লজ্জায় ঘরের মধ্যে বসে থাকতে হত।
সাত বছর বয়সে অ্যাগনেসের পিতার মৃত্যু হয়। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগুন আঁচ পৃথিবীকে একেবারে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। যুগােশ্লোভিয়াতে খুব কষ্ট করে অ্যাগনেসের মা সন্তান তিনটিকে মানুষ করতে থাকেন। মায়ের প্রেরণাতেই অ্যাগনেস দরিদ্রের প্রতি ভালােবাসার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। আর ছিল ঈশ্বরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। অল্পবয়স থেকেই তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যকলাপের সঙ্গে নিজেকেঞ্জড়িয়ে রেখেছিলেন।
স্কুলে পড়বার সময় সােডালিটির সঙ্গে মিশনারীদের কাজকর্মের কথা শুনেছিলেন। সঙ্ঘের পত্র পত্রিকাগুলি নিয়মিতভাবে পড়তেন। এইসব পত্রিকায় পাতায় পাতায় ভারতবর্ষ সম্পর্কে অনেক খবর প্রকাশিত হত।
স্কোপজে পাবলিক স্কুলের ক্লাসে যুগােশ্লোভিয়ার জেসুইটদের লেখা চিঠি পড়ে শােনানাে হত। এইসব চিঠি শুনতে শুনতে কলকাতার প্রতি অদম্য আকর্ষণ জন্মায় অ্যাগনেসের মনের ভেতর।
তিনি খবর নিয়ে জানতে পারলেন যে, আয়ারল্যাণ্ডে লরেটো সজ্ঞা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করছে। এই সঙ্রে প্রধান কার্যালয় ডাবলিনে। তিনি ডাবলিনের সঙ্গে যােগাযােগ করলেন। মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিলেন। মা রাজি হলেন। শেষ পর্যন্ত অ্যাগনেস সাংসারিক জীবনের সমস্ত সুখ-দুঃখকে দূরে সরিয়ে রেখে চলে এলেন লরেটোতে। এলেন আয়ারল্যাণ্ডের ব্যাথানহামে তখন তাঁর বয়স মাত্র আঠারাে বছর।
১৯২৮ সালে অ্যাগনেসের জাহাজ ভেসে চলল শহর কলকাতার দিকে কলকাতায় এসে যােগ দিলেন আইরিশ সন্ন্যাসিনীদের প্রতিষ্ঠান সিস্টারস অব
লরেটোতে। তখন থেকে অ্যাগনেস মনে প্রাণে একজন ভারতীয় হয়ে গেলেন। শিক্ষানবিশি পর্ব শেষ করার জন্য তাঁকে দার্জিলিং-এ পাঠিয়ে দেওয়া হল। দু’বছরের পাঠক্রম কঠিন কঠোর পরিশ্রমে শেষ করে হলেন সিস্টার অ্যাগনেস। এন্টালি সেন্টমেরী স্কুলে বাংলা বিভাগের শিক্ষয়িত্রী পদে আসীন ছিলেন। ১৯৪২ সালে হলেন অধ্যক্ষা। স্কুলে পড়াবার সময় মতিঝিল বস্তির বাসিন্দাদের দরিদ্রতা দেখে খুবই ব্যথা পেয়েছিলেন।
সেটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। মানুষের তৈরি করা দুর্ভিক্ষ শহর কলকাতাতে গ্রাস করে ফেলেছে। দলে দলে নিরন্ন মানুষের ভিড় দেখা যাচ্ছে পথে প্রান্তরে। একটুখানি যত্নের জন্য তাদের আর্তনাদ বাতাস ভারী করে তুলেছে।
সিস্টার অ্যাগনেস এই সময় তাঁর কাজ শুরু করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পেছনে বন্ধন থাকলে দরিদ্র আতুরদের কাজে নিজেকে নিয়ােজিত করা যায় না। তাই চারদেওয়ালের নিশ্চিন্ত গণ্ডি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে।
১৯৪৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দার্জিলিং যাবার সময় তাঁর এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা হল। মনে হল ঈশ্বর যেন তাকে আদেশ করেছেন সাধারণ মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে।
এই প্রসঙ্গে মাদার লিখেছেন—A call with… the message was fear. I was to live the convent and help the the poor, while living among them. গরিবের সেবা করতে হবে, তাদের মধ্যে থাকতে হবে। মাদার সেটি উপলব্ধি করলেন। তিনি এই দিনটিকে বলেছেন The day of decision, অর্থাৎ অনুপ্রেরণার দিন।
মাদার সুপিরিয়ারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে অ্যাগনেস লরেটোর কাজ ছেড়ে দিলেন। সন্ন্যাসিনীদের আলখাল্লা ছেড়ে দিয়ে পরে নিলেন মােটা নীল পাড় শাড়ি। সেদিন তাঁর সম্বল বলতে ছিল পাঁচ টাকা, একটি বাইবেল, ক্রশ গাঁথা জপের মালা। শুরু হল একক পথ পরিক্রমা।
১৯৫০ সালে স্থাপিত হল মিশনারিজ অব চ্যারিটি। এইভাবে তিনি শহর কলকাতায় দুঃস্থ নিরন্ন মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়ােগ করলেন। ধীরে ধীরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে তাঁর নাম পৌছে গেল আজ সারা পৃথিবীতে মিশনারিজ অব চ্যারিটি একটি উল্লেখযােগ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। মাদার অক্লান্ত পরিশ্রম করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি একটির পর একটি শিশুভবন, মহিলা কর্মক্ষেত্র, ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা কেন্দ্র খাদ্য এবং বস্ত্র বিতরণ কেন্দ্র, নৈশাবাস, দুঃস্থ কুটির ইত্যাদি তৈরি করেছেন।
১৯৬২ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করে। সে বছর মাদার ম্যাকসেসে পুরস্কার পান। আর পান ষষ্ঠ পােপ পলের হাত থেকে ২৩তম পােপজন শান্তি পুরস্কার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বােস্টন শহরে তাঁকে গুড সামারিটন পুরস্কার দেওয়া হয়। একমাস পর জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অ্যাওয়ার্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং পুরস্কার পেলেন। ১৯৭৩ সালে আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ইংল্যাণ্ডের প্রিন্স ফিলিপ তাঁর হাতে তুলে দিলেন টেম্পলটন অ্যাওয়ার্ড ফর প্রগ্রেস ইন রিলিজিয়াশ আর ১৯৭৯ সালে পেলেন শান্তিতে নােবেল পুরস্কার। পরের বছর তাঁকে ভারত সরকার ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
অবশ্য এইসব পুরস্কার মাদারের কাছে কিছুই নয়। তিনি সব থেকে বড় পুরস্কার পেয়েছেন নিরন্ন নিরাশ্রয় মানুষদের কাছ থেকে। সারা পৃথিবীর সমস্ত অসহায় মানুষের মুক্তিদাত্রী মাদারের মৃত্যু হয় ১৯৯৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর।
আরও পড়ুন –
সরােজিনী নাইডু | নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া |Nightingale of India| Sarojini Naidu
3 thoughts on “মাদার টেরেসা | বিশ্বজননী |সেবার প্রতীক | Mother Teresa”