স্বামী বিবেকানন্দ
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ১২ জানুয়ারী ভাের ৬টা বেজে ৩৩ মিনিট ৩৩ সেকেণ্ডে ভুবনেশ্বরী দেবীর একটি ছেলে হল—ছেলেটি সত্যিই সুন্দর এবং ফুটফুটে মনে হয় যেন দেবশিশু।
বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন শিশুটির পিতা। উত্তর কলকাতার সিমুলিয়া পল্লীতে তাদের বাড়ি। মা ভুবনেশ্বরী দেবী, শিশুর নাম বললেন ‘বীরেশ্বর’। পিতা নামটি ছােট করে নাম দিলেন শিশুটির বিলে।
নতুন খােকার ‘ নাম অন্নপ্রাশনের সময় বদলানাে হল। নতুন নাম রাখা হল শিশুটির নরেন্দ্রনাথ। স্বামী বিবেকানন্দ—এই নামটি নরেন্দ্রনাথ সন্ন্যাস গ্রহণ করে পেয়েছিলেন।
ছােটবেলায় ‘বীরেশ্বর’ বা বিলে খুবই দুষ্টু ছিল। তবে তার মা ভুবনেশ্বরী দেবী তাকে শান্ত করার একটি উপায়ও বার করেছিলেন।
বিলের মা ‘শিব-শিব’ বলে দুরন্ত ছেলের মাথায় জল ঢেলে দিতেন আশ্চর্যের বিষয় এই যে দুরন্ত ছেলে বিলে সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ তৎক্ষণাৎ শান্ত হয়ে যেত।
আর একটি প্রিয় খেলা ছিল বিলের ধ্যান করা। ধ্যানের সময় সে তার দুটি ভ্র-এর মাঝে একটি গােলাকার জ্যোতির্পিণ্ড তার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়তে ঘুমের আগে। বীরেশ্বর ভাবত এই জ্যোতি ঘুমােবার আগে সবাই দেখে।
বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন বালক বীরেশ্বরের মনে সর্বদাই আনাগােনা করতাে। যেমন হাতে যদি এটো না লাগে তাহলে এঁটো থালায় হাত দিলে হাত ধুতে হয় কেন? এছাড়াও নীচু জাতের এঁটো খেলে জাত যাবে কেন? গুরুজনেরা বা বাড়ির বড়রা সর্বদাই বলতেন—ও গাছে উঠো না উঠলে ভূতে ধরবে। সত্য কি মিথ্যা? এই সমস্ত উক্তির সত্য-মিথ্যা বিচার করে নিত বালক বিলে।
প্রাথমিক শিক্ষা বীরেশ্বরের সম্পূর্ণ হয় বাড়িতে। তারপর কলকাতার মেট্রোপলিটন স্কুলে সে ভর্তি হয়। স্কুলে যেতে বীরেশ্বরের ভয় এবং স্বাধীনতা নেই সেখানে বিলের একদম পছন্দ নয়। সেইজন্যই স্কুলে যেতে সে এত নিরুৎসাহ এবং স্কুলে যেতে বিলে একদম পছন্দ করতেন না।
বিলে বালক হয়েও অনেক গুণের অধিকারী সে। সে সত্য কথা বলতে পছন্দ করে, অত্যন্ত সাহসী সে। দানশীল আর অসামান্য প্রতিভার অধিকারী।
একদিন রাস্তায় গাড়ি ঘােড়ার ভিড়। প্রচুর ছেলে বাড়ি ফিরছে চড়কের মেলা দেখে। অসাবধানবশত একটা ছােট ছেলেকে গাড়ি চাপা পড়তে দেখে তীব্র গতিতে ছুটে গিয়ে ছেলেটিকে গাড়ির সামনে থেকে টেনে নিয়ে এলাে।
এই সাহসী, ছেলের নাম বীরেশ্বর এবং এই বীরেশ্বরই অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দিল ছেলেবেলায়।
আবার একদিন একজন সন্ন্যাসী ভিক্ষা চাইতে এসেছে। সেই সময় বিলের মা ঘুমােচ্ছিল। কি দেবে সন্ন্যাসীকে? ভাঁড়ার ঘরে মা তালা বন্ধ করে রেখেছেন। কিন্তু সন্ন্যাসীকে তাে খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং বীরেশ্বর নিজের পরনের ধুতিখানি খুলে সন্ন্যাসীর হাতে দিয়ে দিল। সন্ন্যাসী সেই ধুতিটি মাথায় জড়িয়ে হাত তুলে বীরেশ্বরকে আশীর্বাদ করল। এহেন বালকের নাম বীরেশ্বর বা বিলে।
স্কুলে আর একদিন ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে বসে বীরেশ্বর আর কয়েকটি ছেলে গল্প করছিল। মাস্টারমশাই না দেখেই বীরেশ্বরকে বললেন পড়া বলতে। বীরেশ্বর গড় গড় করে পড়া মুখস্থ বলে দিল।
মাস্টারমশাই তখন বললেন, যারা গল্প করছিল, তারা এবার দাঁড়াও। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল অন্য ছেলেদের সাথে বিলেও দাড়িয়েছে। মাস্টারমশাই তখন বিলেকে বললেন যে বিলে তুই বস। কিন্তু বীরেশ্বর বলল, স্যার আমিও যে গল্প করছিলাম। বিলে সত্যবাদী। জবাব দিল সত্যবাদী বালক বীরেশ্বর। >
প্রচণ্ড মেধাবী ছাত্র ছিলেন নরেন্দ্রনাথ। তিনি তিন বছরের পড়া এক বছরে শেষ করলেন। তাঁর যেমন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছিল তেমনই ছিল স্মৃতিশক্তি প্রখর। তারপর ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করলেন।
তাঁর চরিত্রের প্রচুর গুণ দেখা যেত। সবাইকে ভালােবাসা এবং গুরুজনদের শ্রদ্ধার চোখে দেখা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ। নিন্দা শুনে তিনি কোনদিনও বিচলিত হতেন না। নরেন সমবয়সি যুবকদের নেতৃত্ব দিতেন। যা বা যেটা অন্যায় তার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ করতেন। এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি মাথা তুলে দাঁড়াতেন।
সত্য ও ঈশ্বর দর্শন—এই ইষ্ট লাভের জন্য যুবক নরেন্দ্রনাথের মন চঞ্চল হয়ে উঠল। সেই সময় বাংলাদেশে সাধু সন্ন্যাসীর কোনাে অভাব ছিল না। এছাড়াও ধর্ম প্রচারকেরও কোন অভাব ছিল না সেই সময়। এইসব ধর্ম প্রচারকদের কাছে তিনি ছুটে যেতেন। তাঁর একটাই প্রশ্ন রইল তাঁদের কাছে এই যে তাঁরা ঈশ্বর দর্শন করছেন কিনা।
এসব খুবই শক্ত প্রশ্ন। কোনাে লােকেই এর সঠিক উত্তর দিতে পারতাে না। তাঁরা অন্যরকম উপদেশ দিয়ে কথা ঘুরিয়ে দিতেন।
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে সুরেন মিত্তিরের বাড়িতে গানের আসরে নরেনের সঙ্গে পরিচয় হয় শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ নরেনের নাম শুনে যৎপরনাস্তি খুশি হলেন। নরেনকে দক্ষিণেশ্বরে যাবার জন্য অনুরােধ জানালেন। নরেন ঠাকুরকে যাবার কথা দিলেন। কিন্তু এম, এ. পরীক্ষার জন্য তিনি দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন : মশাই আপনি ভগবানকে দেখেছেন? রামকৃষ্ণদেব বললেন, “হ্যা রে দেখেছি এবং তােকেও দেখাতে পারি। দেখবি তুই?” :
এই কথা শুনে নরেনের মন অত্যন্ত আনন্দে ভরে গেল। স্তম্ভিত হয়ে এবং বিস্ময়ে তিনি ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের কাছে বসে থাকলেন।
কিছুদিন পরে নরেন্দ্রনাথের পিতা বিশ্বনাথ দত্ত মারা গেলেন। সংসারের সমস্ত দায়-দায়িত্ব নরেনের উপর এসে পড়ল। বিশ্বনাথ দত্ত রােজগার করেছিলেন প্রচুর কিন্তু একটি পয়সাও তিনি সঞ্চয় করে রেখে যেতে পারেন নি। সেই জন্য দত্ত বংশের খুবই অভাব দেখা যায়। নরেন্দ্রনাথ চাকরির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগলেন। কিন্তু কোনাে চাকরিও তিনি পেলেন না। সেইজন্য তিনি মনে খুব কষ্ট পেলেন এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে বলতে লাগলেন যে ভগবান কি গরিবের কথা শােনেন না? তিনি কি পারেন না নরেনের পরিবারের জন্য দুমুঠো ভাতের বা অন্যের ব্যবস্থা করে দিতে? এই কথা মনে করতে করতে তিনি একদিন দক্ষিণেশ্বরে শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের কাছে পৌছে গেলেন। নরেন শ্রী রামকৃষ্ণদেবের কাছে এত দুঃখের কথা সব খুলে বললেন। আরও বললেন যে তিনি যেন মা কালীর কাছে তাঁর হয়ে প্রার্থনা করে বলেন নরেনের পরিবার দুটি খেয়ে পরে বাঁচতে পারে।
ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ বললেন যে তিনি মা কালীর কাছে নিজের জন্য কিছুই চান না, নরেনকে তবে একথা তিনি বলেছেন যে আজ রাতে তুই মা কালীর কাছে যা চাইবি তাই পাবি।
ঠাকুরের কথা সত্যি হয় কিনা সেকথা মনে মনে ভাবতে লাগলেন নরেন। কালীমন্দিরে যখন সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে তখন নরেন মায়ের কাছে বসে ভক্তি সহকারে মাকে প্রণাম করে মাকে বললেন : “মা আমাকে বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও, দাও শুধু ভক্তি।”
ঠাকুর নরেনকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি চাইলি মায়ের কাছে? নরেন উত্তর দিলেন “না, টাকাকড়ি চাইতে পারলাম না।”
রামকৃষ্ণ আবার নরেনকে পাঠালেন মায়ের কাছে বারবার তিনবার ঠাকুর নরেনকে মায়ের কাছে পাঠালেন। কিন্তু নরেন তিন-তিনবারই মায়ের কাছে গিয়ে একই প্রার্থনা জানালেন : মা আমাকে বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও। দাও শুদ্ধ ভক্তি। কিন্তু কিছুতেই তিনি টাকাপয়সা মায়ের কাছে চাইতে পারলেন না। নরেনের প্রার্থনা কিন্তু বিফলে যায়নি। তিনি মা কালীর কাছে যা প্রার্থনা করেছেন তাই পেয়েছিলেন।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তারপর তিনি দেহ ত্যাগ করেন। স্বামী বিবেকানন্দ শুরু করলেন তাঁর কর্মময় জীবন।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ অসুস্থ হন। তখন তিনি নরেনকে ডেকে বললেন “আমি শীঘ্রই দেহত্যাগ করবাে।” আমার ভক্তরা সবাই রইল। তুই, ওদের সবার সেরা। ওদের তুই দেখিস। সৎ পথে চালাস। এরপর নরেন্দ্রনাথ দীক্ষা নিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছে। তখন তাঁর নাম হল স্বামী বিবেকানন্দ। দীক্ষা নেওয়ার পর তিনি গেরুয়া বসন ধারণ করেন।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কৃপায় তিনি সত্য পথের সন্ধান পেলেন। ১৮৮৬ খ্রিঃ রামকৃষ্ণ মহাসমাধি লাভ করার পর তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন যে তাঁকে হিন্দু ধর্মের সংস্কার ও পুনরুদ্ধার করতে হবে। এরপর সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে তিনি সারা ভারতে ভ্রমণ করে বেড়ালেন। বহু লােক তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন বিনা দ্বিধায় ভারতে সর্বত্র স্থান থেকে।
১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগাে শহরে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের একটি মহা সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছিল। তার প্রিয় শিষ্যরা মনে প্রাণে চাইলেন যে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জনকারী স্বামী বিবেকানন্দ ভারতীয় হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করুন। স্বামী বিবেকানন্দ ইংরাজিতে প্রচণ্ড দক্ষতার সঙ্গে অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। তিনি আমেরিকায় গেলেন এবং হিন্দুধর্মের গভীরতা সম্বন্ধে প্রচণ্ড দৃঢ়তার সঙ্গে বক্তৃতা দিলেন। আমেরিকা বাসীরা তাঁর বক্তৃতায় এক কথায় স্তম্ভিত, অভিভূত হয়ে যায় এবং ধন্য ধন্য করতে থাকে।
স্বামী বিবেকানন্দের গভীর পাণ্ডিত্য, ধর্ম জ্ঞান, এবং ধর্মীয় প্রচারকার্যের জন্য ব্রিটেন আমেরিকার ভারতীয় সংস্কৃতি সভ্যতা ও ধর্ম সম্বন্ধে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও শিক্ষিত মানুষের মধ্যে প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়। প্রায় চার বৎসর পর স্বামী বিবেকানন্দ দেশে অর্থাৎ ভারতে ফিরে এলেন এবং তিনি “শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ মিশন”-এর প্রতিষ্ঠা করলেন। এই মিশনের প্রধান উদ্দেশ্য হল দরিদ্র মানুষের সেবা করা।
মাত্র ৩৯ বছর বয়সে এই বীর সন্ন্যাসী ১লা জুলাই ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে অমৃতলােকে যাত্রা করেন। হিন্দু ধর্মের পুনরায় উদ্ধার পুনরুজ্জীবন সমাজ সংস্কার এবং মানব সেবার জন্য সমগ্র ভারতবাসীর কাছে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।
তাঁর এত বড় প্রতিভা ও মহত্বকে স্বীকার করার জন্য এবং স্বামী বিবেকানন্দের মহত্ত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভারতের দক্ষিণ প্রান্ত কন্যাকুমারীকায় স্বামী বিবেকানন্দ মেমােরিয়াল হল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এছাড়াও স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাঁর জন্মস্থানের কাছেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেলুড় মঠ। তাঁর অগণিত শিষ্য এবং শিষ্যাদের মধ্যে মিশ মার্গারেট এলিজাবেথ নােবেল নামে একজন ইংরেজ শিষ্যা সিস্টার নিবেদিতা নাম গ্রহণ করে তাঁর প্রতিভা আদর্শ ও সেবাব্রতের কাজের জন্য ভারতের বিভিন্ন স্থান সেবাশ্রম গড়ে তােলেন।
স্বামী বিবেকানন্দের অমৃতবাণী যুগ যুগ ধরে সারা বিশ্বের মানুষের মনে এবং মানব সমাজে গাঁথা হয়ে থাকবে—
‘বহুরূপে সম্মুখে তােমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর। জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
আরও পড়ুন –
ভগিনী নিবেদিতা – স্বামী বিবেকানন্দের স্বনামধন্যা শিষ্যা,সন্ন্যাসিনী।
3 thoughts on “স্বামী বিবেকানন্দ- বীর সন্ন্যাসী, হিন্দু ধর্মের প্রচারক, সমাজ সংস্কারক, জাতীয়তাবাদী।”