ভগিনী নিবেদিতা
বিদেশিনী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভারত মায়ের শৃঙ্খল মােচনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। মনে-প্রাণে ভারতীয় হয়ে উঠেছিলেন। তিনি হলেন মার্গারেট
এলিজাবেথ নােবেল, তাঁকে আমরা ভগিনী নিবেদিতা নামেই চিনে থাকি।
বিদেশি এই তরুণীকে নিবেদিতা নাম দিয়ে চিরকালের জন্য আমাদের মনের মধ্যে স্থান দিয়েছি।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের অন্তর্গত ডানগানা নামক এক ছােটো শহরে ১৮৬৭ সালের ২০ অক্টোবর মার্গারেট নােবেলের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম স্যামুয়েল বিচমন্ড নােবেল এবং মায়ের নাম লেডি ইসাবেল হ্যামিলটন।
মার্গারেট যখন বালিকা তখন তাঁর মা-বাবা জীবিকার সন্ধানে ইংল্যাণ্ডে কয়লাখনি অঞ্চলে ম্যানচেস্টারে চলে আসেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ধর্মযাজক। তিনি পবিত্র সৎ জীবন যাপন প্রয়াসী ছিলেন।
মার্গারেট থেকে যান তাঁর ঠাকুরমার কাছে। ঠাকুরমাই ছিলেন তাঁর শৈশবে একান্ত আপনজন। মার্গারেট ছিলেন অত্যন্ত অভিমানী স্বভাবের বালিকা, সামান্য কথাতেই চোখে জল আসত। আবার ছােট্ট উপহার পেলেই সবকিছু ভুলে যেতেন।
বাড়ির পরিবেশ ছিল ভারি সুন্দর। প্রকৃতির খেয়ালি লেখা ঘুরে বেড়াতে ভালােবাসতেন। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতেন অস্তমিত সূর্যের বিদায়ী রক্তরাগের দিকে। পৃথিবী কত সুন্দর, গালে হাত দিয়ে সে কথাই ভাবতেন।
তখন থেকেই তাঁর মনের ভেতর এক ধরণের সৌন্দর্য-চেতনার জন্ম হয়।
বাড়িতে ঠাকুরমা আর জর্জ কাকা ছিলেন মার্গারেটের নিত্যদিনের খেলার সঙ্গী। সন্ধ্যায় আগুনের ধারে বসে ঠাকুরমার মুখ থেকে শুনতেন পুরাণের গল্পকথা। তারপর জর্জ কাকার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তেন সেদিনের সদ্যবালিকা মার্গারেট।
মার্গারেটের বয়স যখন মাত্র সাতবছর তখন ঠাকুরমার মৃত্যু হল। এই শােক মার্গারেট সহ্য করবেন কেমন করে। বিরাট এই পৃথিবীতে তখন নিজেকে বড্ড নিঃসঙ্গ এবং একা বলে মনে হল মার্গারেটের।
এই সময় তাঁর বাবার শরীর অত্যন্ত খারাপ হয়। তিনি মার্গারেটকে সঙ্গে নিয়ে একটি গ্রামে চলে আসেন। সেখানে এক ভাই এবং এক বােনকে সঙ্গী হিসাবে পেয়েছিলেন মার্গারেট।
ইতিমধ্যে বয়েস কিছুটা বেড়ে গেছে মার্গারেটের। তিনি বুঝতে পারেন বাবা হয়তাে আর কোনােদিন কাজ করতে পারবেন না। তা সত্ত্বেও তাঁকে গির্জার উপাসনা সভায় যােগ দিতে হয়। বুকে অসহ্য যন্ত্রণা তবু সে যন্ত্রণা সহ্য করে ভাষণ দিতে হয়।
মার্গারেটের ঠাকুরদাদা ছিলেন এক বিখ্যাত দেশনেতা। দাদামশাই ছিলেন আয়ারল্যাণ্ডের এক নামী মানুষ। মায়ের কোলে বসে মার্গারেট ঠাকুরদাদা এবং দাদামশাই-য়ের নানা গল্প শুনতেন। গল্প শুনতে শুনতে গৌরবের অহঙ্কারে উজ্জীবিত হয়ে উঠতেন তিনি। আর ভাবতেন, এত বড়াে বংশে আমার জন্ম, আমার ঠাকুরদাদা-দাদামশাই সবাই কৃতী পুরুষ, আমি কি তাঁদের উত্তরসূরি হয়ে উঠতে পারব?
স্যামুয়েল নােবেলের এক ধর্মযাজক বন্ধু একদিন মার্গারেটকে দেখে খুবই খুশি হয়েছিলেন। মার্গারেটের সাগরনীল চোখের তারায় কী এক আশ্চর্য রহস্যের দূতি। তিনি ভাবতেন, আকাশের সেরা তারার আলাে লুকিয়ে আছে এই দুটি চোখের তারায়।
পরম স্নেহে বন্ধুকন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বলেছিলেন—“মাগাে অনেক দূরে ভারতবর্ষ বলে একটি দেশ আছে। সেই দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্রতার অভিশাপে অভিশপ্ত। যদি কখনাে তুমি ভারতমাতার ডাক পাও তাহলে সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব দূরে ফেলে রেখে সেই দেশে চলে যাও।”
বাবার এই ধর্মযাজক বন্ধু ভারত থেকে সবেমাত্র ইংল্যাণ্ডে ফিরেছেন।
বাবার কাছে ভারতবর্ষের অনেক গল্প শুনেছেন মার্গারেট কিন্তু বাবার বন্ধুর মুখে ভারতবর্ষের কথা শুনে তাঁর সমস্ত শরীর শিহরীত হয়ে উঠল। সেদিন থেকেই মার্গারেটের মনের ভেতর ভারতবর্ষ শব্দটি গেঁথে গিয়েছিল।
বাবা অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে উঠলেন। কিছুদিনের মধ্যেই মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে স্যামুয়েল নােবেলের মৃত্যু হল।
মৃত্যুর আগে পত্নীকে কাছে ডেকে তিনি বলেছিলেন—“শােননা, মার্গারেট যা চায়, ওকে তাই হতে দিও, ওর চলার পথে কখনাে কোনাে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাে না।” >
মার্গারেটকে আমরা এক উড়ন্ত বিহঙ্গের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। স্কুলের পড়াশােনা তাঁর মােটেই ভালাে লাগত না। বিশ্বপ্রকৃতিকে জানবার জন্য তিনি আগ্রহী হয়ে উঠতেন।
তবুও মার্গারেটকে স্কুলে পড়তে হত। সেখানে গিয়ে সকলের নেত্রী হয়ে উঠলেন। তাঁর মধ্যে অনেকগুলি গুণ ছিল। খুব ভালাে অভিনয় করতে পারতেন। ভালােবাসতেন সাহিত্য পড়তে, এমনকি বিজ্ঞানের বিষয়েও তাঁর অত্যন্ত আগ্রহ ছিল।
মার্গারেটের বয়স তখন মাত্র তেরাে বছর। পড়তেন তিনি হ্যারি ফ্যাকস বিদ্যায়তনে, একদিন সাহিত্যের শিক্ষিকা মিস কলিনকে একটি প্রশ্ন করে অবাক করে দিলেন। মার্গারেট জানতে চেয়েছিলেন—জীবনের শেষ কোথায় ? মৃত্যুই কি জীবনের পরিসমাপ্তি? মৃত্যুর পরপারে কি আর একটি জীবন থাকে না? দূরদর্শনী এই শিক্ষিকা বুঝতে পেরেছিলেন মার্গারেটের মধ্যে একটি অনুসন্ধিৎসু মন লুকিয়ে আছে। তিনি হয়তাে সেদিন মার্গারেটের কঠিন এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেননি, কিন্তু মার্গারেট যে সত্যি সত্যি আলাদা তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
স্কুলে ছুটি হলে মার্গারেট এবং তার বােন দাদুর বাড়িতে ফিরে যান। দাদু ওদের নিয়ে বেলফাস্ট বন্দরে চলে আসেন। তখন দিনগুলাে বড়াে আনন্দে কেটে যায়।
দাদুর কত জ্ঞান। পৃথিবীর সব খবর তাঁর নখদর্পণে। দাদুর মুখ থেকে দু’বােন শশানেন নানা দেশের গল্পকথা।
দাদু যখন নাতনিকে দেখিয়ে বলেন, আমাদের এই মেয়েটি যে সে নয়, জন নােবেলের ছেলের মেয়ে, তখন মার্গারেটের মুখ লাল হয়ে ওঠে। বুক ফুলে ওঠে গর্বে।
মার্গারেট অনুভব করেছিলেন তাকে এক মহান বংশপরম্পরার উত্তরাধিকারী হতেই হবে। স্কুলের শেষ, পরীক্ষায় ভালােভাবে পাশ করলেন মার্গারেট। এখন তাঁর সামনে অনেকগুলি কাজ। প্রথম কাজ হল মায়ের দুঃখ-কষ্ট দূর করা। সবার ছােটো অকালে পিতৃহারা ছােটো ভাইটি, ভাইয়ের পড়াশােনার ব্যবস্থা করতে হবে।
মার্গারেট অনুভব করেছিলেন শিক্ষাই হল একটি জাতির মেরুদণ্ড। তাই ১৮৮৬ সালে এলেন খনি শহর রেকসাহামে। সেন্ট মার্কাস চার্চে শিক্ষয়িত্রীর কাজ নিলেন। এর পাশাপাশি চলল তাঁর সমাজ সেবার কাজ।
এরপর মার্গারেটের সাথে বিশ্বপথিক স্বামী বিবেকানন্দের দেখা হয়। বিবেকানন্দের সংস্পর্শে আসার পর তাঁর চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়। বিবেকানন্দের ডাকে এলেন ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষকে তাঁর স্বপ্নের কর্মক্ষেত্র করে তুললেন। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বাগবাজার বােসপাড়া লেনে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন।
তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন মহান ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যেমন, রবীন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র, গিরিশ ঘােষ, জগদীশচন্দ্র প্রমুখ। যােগাযােগ হয় বিপ্লবী মহানায়ক অরবিন্দের সঙ্গে। বহু বিচিত্র কর্মধারার সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন। একদিকে তিনি যেমন ভারতীয় শিল্প, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিলেন, অন্যদিকে ভারতের সশস্ত্র আন্দোলনকে নানাভাবে সাহায্য করে গেছেন।
ভারতীয় আধ্যাত্মিক সাধনায় অনুপ্রাণিত হয়ে একে একে রচনা করলেন Kali The Mother, Story of Kali, The vision of Siva, The voice of Mother আর লিখলেন আত্মজবনীমুলক এক অসাধারণ গ্রন্থ The Master As I Saw Him.
১৯০২-১৯১১ ভারত ইতিহাসের এক যন্ত্রণা দগ্ধ অধ্যায়। এই সময় নিবেদিতাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল। ১৯১১ সালে জগদীশচন্দ্র বসুর পরিবারের সঙ্গে এলেন দার্জিলিং-এ। সেখানে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটল ১৩ অক্টোবর সকাল ৯টায়।
ভারতের জন্য নিবেদিত প্রাণ বলে বিবেকানন্দ তাঁকে বলতেন ভগিনী নিবেদিতা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম দিয়েছিলেন লােকমাতা। জগদীশচন্দ্র বলতেন শিখাময়ী। আমরা কোনাে দিন ভগিনী নিবেদিতাকে ভুলতে পারব না।
আরও পড়ুন –
স্বামী বিবেকানন্দ- বীর সন্ন্যাসী, হিন্দু ধর্মের প্রচারক, সমাজ সংস্কারক, জাতীয়তাবাদী।
2 thoughts on “ভগিনী নিবেদিতা – স্বামী বিবেকানন্দের স্বনামধন্যা শিষ্যা,সন্ন্যাসিনী।”